সড়কে আইন কঠিন হলেও কমেছে প্রয়োগ

সড়ক পরিবহন খাতে কঠোর আইন করা হলেও সড়কে চলছে কঠোর আইনের দুর্বল প্রয়োগ। ১ নভেম্বর কার্যকরের পর বহুল আলোচিত এ আইনে পুরো মাসে মামলা হয়েছে শ’খানেক। কিন্তু এর আগের মাস অক্টোবরে পুরোনো মোটরযান অধ্যাদেশে রাজধানীতে মামলা হয়েছিল এক লাখ ৮৭ হাজার। ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকে নতুন আইন প্রয়োগ শুরু করেছে পুলিশ। তবে দুই দিনে মামলা তিনশ’ পার হয়নি।

অথচ আগে দিনে গড়ে ছয় হাজার মামলা হতো। একই অবস্থা সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। অক্টোবর মাসে ঢাকায় এক হাজার ২৩৯টি মামলা দায়ের করা হয়। নভেম্বরে মামলার সংখ্যা হাতেগোনা। জরিমানা এবং গাড়ি জব্দের সংখ্যাও কমেছে। নভেম্বর মাসে কারাদণ্ড হয়নি একজনেরও। সড়ক আইন প্রয়োগকারী দুই সংস্থা বিআরটিএ এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)

বলছে, জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য ছাড় দেওয়া হয়েছে। তবে সূত্র বলছে, আইনের কঠোর প্রয়োগ হলে ফের গাড়ি বন্ধ করে অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে পারেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। এ শঙ্কাতেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে মালিক-শ্রমিকদের দাবিতে আইনের ১২৬টি ধারার তিনটির প্রয়োগ আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। অথচ এই সুযোগে পুরো আইনটিরই প্রয়োগ দুর্বল হয়ে গেছে।

মামলা, জরিমানা প্রায় ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ কমে গেলেও বিআরটিএ চেয়ারম্যান ড. কামরুল আহসান বলেছেন, জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং প্রস্তুতির জন্য কিছুটা সময় দেওয়া হয়েছিল। তাই মামলা কম। তবে আগামী দিনগুলোতে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা হবে। একই কথা বলেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপির) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ। তবে নিরাপদ সড়ক চাই-নিসচার চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, ‘দুঃখের কথা হলো, এর মাধ্যমে শুরুতেই আইন হোঁচট খেয়েছে।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন কার্যকরের পর প্রথম কয়েক দিন জরিমানার ভয়ে রাস্তায় গাড়ি সুশৃঙ্খলভাবে চললেও, আইনের প্রয়োগ না থাকায় আবার নৈরাজ্য ফিরে এসেছে। আবার গাড়ি যেমন খুশি চলছে। সড়কে ফের ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালক ফিরে এসেছে। গাড়ির কাগজ হালনাগাদ করতে বিআরটিএতেও সেই ভিড়ও নেই।

জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, চালক, মালিক, পথচারী, যাত্রীসহ সবার মধ্যে জরিমানার যে ভয় ছিল, আইনের প্রয়োগ না থাকায় তা কেটে গেছে। আইন না মানার মানসিকতা আবার ফিরে এসেছে। উন্নত দেশে নমনীয় আইন করে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। বাংলাদেশে উল্টো হয়েছে। জেল-জরিমানা বাড়িয়ে সড়ক পরিবহন আইনকে কঠোর করা হয়েছে; কিন্তু প্রয়োগ করা হচ্ছে দুর্বলতমভাবে।

বেপরোয়া বাসের চাপায় দিয়া-রাজীবের মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে গত বছর দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সাত বছর ঝুলে থাকার পর পাস হয় সড়ক পরিবহন আইন। এতে সড়কে আইন ভঙ্গে জরিমানা বেড়েছে ১০ থেকে হাজার গুণ। বেড়েছে কারাদণ্ডও। আগের আইনে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর জরিমানা ছিল ৫০০ টাকা। নতুন আইনে সর্বোচ্চ জরিমানা ২৫ হাজার টাকা। অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রেও এভাবে জরিমানা বাড়ানো হয়েছে। গাড়ির আকার পরিবর্তন, সড়কে কাউকে আহত, নিহত করার মামলা জামিন অযোগ্য করা হয়েছে আইনে।

ডিএমপির তথ্যানুযায়ী, নতুন আইন কার্যকরের আগে গত অক্টোবর মাসে পুরোনো মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩-তে এক লাখ ৬৩ হাজার ২৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়। ডাম্পিং করা হয় এক হাজার ৩০টি গাড়ি। ভিডিও মামলা হয় ২৩ হাজার ৬৬২টি। জরিমানা আদায় করা হয় সাত কোটি চার লাখ ৫৫ হাজার ৯৩ টাকা।

সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের পর নভেম্বর মাসের প্রথম ১৫ দিনে একটি মামলাও করা হয়নি। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মৌখিক নির্দেশে এ ছাড় দেওয়া হয়েছিল। ১৫ নভেম্বর থেকে পরবর্তী ১৫ দিনে কতটি মামলা দায়ের করা হয়েছে, কত টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে, তা জানায়নি ডিএমপি। তবে সংস্থাটির সূত্রের খবর, নভেম্বরে মামলার সংখ্যা শ’খানেক। জরিমানা আদায় লাখ টাকার কম।

ডিএমপির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পারিপার্শ্বিক ‘অবস্থা’ এবং ‘বাস্তবতার’ কারণে এ আইনে পুলিশ কঠোর হতে পারছে না। জেল-জরিমানা করলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা গাড়ি বন্ধ করে যাত্রীদের জিম্মি করতে পারেন- এ আশঙ্কা যেমন রয়েছে, তেমনি উচ্চহারে জরিমানা হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই আইনের কঠোর প্রয়োগ করা হচ্ছে না। এ ছাড়াও আইন প্রয়োগের প্রস্তুতিও ছিল না পুলিশের।

সড়কে আইন ভঙ্গে পুলিশ অনলাইনে মামলা করে। ট্রাফিক কর্মকর্তাদের কাছে থাকা পস মেশিনে সফটওয়্যার ইনস্টল রয়েছে, কোন আইন ভঙ্গে কত টাকা জরিমানা হবে। পস মেশিনে এখনও নতুন আইনের জরিমানার অঙ্ক ইনস্টল করা হয়নি। সড়ক পরিবহন আইনে ৯টি অপরাধে জরিমানা ও মামলা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেছেন, পস মেশিন আপডেট কার্যক্রম শেষ হয়নি, আরও ১০-১২ দিন সময় লাগতে পারে। এর পরই অনলাইনে মামলা করা হবে। আপাতত স্লিপের মাধ্যমে মামলা শুরু হয়েছে।

নতুন আইন প্রয়োগ-সংক্রান্ত তথ্য জানতে গত শনি, রবি এবং সোমবার ডিএমপির ট্রাফিকের চারটি বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা হয়। ট্রাফিক উত্তর বিভাগের মহাখালী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার সুবীর রঞ্জন দাশ, উত্তরা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার কাজী হানিফুল ইসলাম এবং ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের শাহবাগ জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার নুরুন্নবী শনিবার জানিয়েছিলেন, তাদের এলাকায় নতুন আইনে কোনো মামলা হয়নি।

মহাখালী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার সুবীর রঞ্জন দাশ বলেন, রোববার থেকে তার জোনে নতুন আইনে মামলা শুরু হয়েছে। এদিন তার জোনে ১১টি মামলা হয়েছে বলে জানান তিনি। উত্তরা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার কাজী হানিফুল ইসলাম জানান, তার এলাকায় রোববার ১১টি মামলা হয়েছে এবং সোমবার বিকেল পর্যন্ত মামলার সংখ্যা চারটি। শাহবাগ জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার নুরুন্নবী জানান, সোমবার তার এলাকায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে।

ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের মিরপুর জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার তাহ্‌সীনা আরিফ জানান, তার এলাকায় রোববার চারটি এবং সোমবার বিকেল পর্যন্ত পাঁচটি মামলা করা হয়েছে। তিনি বলেন, যাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে, তাদের আগে থেকেই ভিডিও করা হচ্ছে। ভিডিও ফুটেজ দেখিয়ে অপরাধ সম্পর্কে অবহিত করার পর মামলা করা হচ্ছে।

ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের কোতোয়ালি জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার বিমান কুমার দাশ জানান, রোববার থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত তার এলাকায় ২১টি মামলা হয়েছে।

ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের শেরেবংলা নগর জোনের (বিজয় সরণি) ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আজহারুল হক জানান, তার এলাকায় শনিবার থেকে নতুন আইনে মামলা শুরু হয়েছে। ট্রাফিক পূর্ব বিভাগের ডেমরা জোনের (যাত্রাবাড়ী) ট্রাফিক ইন্সপেক্টর অমল কান্তি রায় জানান, তার এলাকায় সীমিত আকারে নতুন আইনে মামলা শুরু হয়েছে। এ আইনে শনিবার একটি মামলা হয়েছে, চলন্ত বাসের দরজা খুলে রাখার অপরাধে তিন হাজার টাকা জরিমানা। ডেমরা জোনের (সায়েদাবাদ) ট্রাফিক ইন্সপেক্টর হোসেন জাকারিয়া মেনন জানান, তার এলাকায় নতুন আইনে মামলা হয়নি।

মাসখানেক আগে আইন কার্যকর হলেও এখনও আইনটির বিধিমালা হয়নি। বিধিমালা প্রণয়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে বলে জানিয়েছেন এর দায়িত্বে থাকা সড়ক পরিবহন বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবদুল মালেক। তিনি বলেছেন, সপ্তাহখানেকের মধ্যে তারা বিধিমালার প্রাথমিক খসড়া মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে পারবেন। এরপর তা চূড়ান্ত করে অনুমোদন পেতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।

সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেছেন, শুধু বিধিমালা প্রণয়ন ছাড়া প্রয়োগ নয়, আইনে আরও অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। এগুলো সংশোধন করতে হবে। নইলে চালক-শ্রমিকদের গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। জরিমানা দিতে দিতেই দিন যাবে।

এ দাবি অন্য পরিবহন নেতাদেরও। সড়ক আইনকে কঠোর আখ্যা দিয়ে শিথিলের দাবি তুলেছেন তারা। এ দাবিতে তাদের আন্দোলনে নভেম্বরের মাঝামাঝি কয়েকদিন সড়ক অচল ছিল। যাত্রীরা ছিলেন জিম্মি। আন্দোলনের পর আইনের তিনটি ধারার প্রয়োগ আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত স্থগিত করা হয়।

বার্তা বাজার/ডব্লিও.এস

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর