গাড়ি না থাকলেও আছে পেট্রোল-লুব্রিকেট বাবদ জ্বালানি ব্যয়

তিন বছরে প্রকল্পের আওতায় কোনো ধরনের যানবাহনই কেনা না হলেও পল্লী বিদ্যুতের দুই প্রকল্পে ইতোমধ্যে পেট্রল ও লুব্রিকেন্ট বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ২০ লাখ ১৪ হাজার টাকা। অন্য দিকে প্রকল্পে যানবাহনের সংখ্যা না বাড়লেও এসব কেনার জন্য ব্যয় দুই প্রকল্পে দুই কোটি ৩২ লাখ ৩০ হাজার টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে; যা নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের আপত্তি রয়েছে। ধীরগতির এই দুই প্রকল্পের গড়ে ৫৩টি অঙ্গের মধ্যে ২৯টি অঙ্গের ব্যয় কমলেও সার্বিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় মোট দুই হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বলে সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

পল্লী বিদ্যুতের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, শতভাগ পল্লী বিদ্যুতায়নের জন্য বিতরণ নেটওয়ার্ক সস্প্রসারণে প্রকল্প-১ রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগ এবং প্রকল্প ২ ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগের জন্য দু’টি পৃথক প্রকল্প গত ২০১৭ সালের জুনে একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়। দু’টির বাস্তবায়ন ব্যয় প্রকল্প-১ এ ছয় হাজার ৭৭৬ কোটি ৯১ লাখ ২৬ হাজার টাকা এবং প্রকল্প-২ এ সাত হাজার ১৩২ কোটি ৩০ লাখ ৯০ হাজার টাকা। তিন বছরে বাস্তবায়নের এই প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত মেয়াদে দু’টি প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি গড়ে মাত্র ৫০ শতাংশ। এখন সময় আরো দুই বছর করে বৃদ্ধি এবং ব্যয় মোট দুই হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলমান দু’টি প্রকল্পের জন্যই ২৭টি করে যানবাহন কেনার কথা ছিল। যার মধ্যে ১টি করে জিপ, ১৪টি করে পিকআপ এবং ১২টি করে মোটরসাইকেল। এই যানবাহনগুলো কেনার জন্য প্রতিটি প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় সাত কোটি ৪৭ লাখ টাকার বেশি। কিন্তু গত তিন বছরে কোনো যানবাহনই কেনা হয়নি। এখন সময় বাড়ানোর প্রস্তাবনায় এসে যানবাহনের সংখ্যা অপরিবর্তিত থাকলেও ব্যয় গড়ে এক কোটি ১৬ লাখ ১৫ হাজার টাকা করে প্রতি প্রকল্পে বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আর এসব যানবাহন কেনা না হলেও এরই মধ্যে পেট্রল ও লুব্রিকেন্ট খাতে দুই প্রকল্পে ১২ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং সাত লাখ ৩৪ হাজার টাকা করে মোট ২০ লাখ ১৪ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। শিল্প ও শক্তি বিভাগ সংস্থার কাছে এর ব্যাখ্যা চেয়েছে।

পর্যালোচনার তথ্য থেকে জানা গেছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেটের জন্য সংশোধিত প্রকল্পের আওতায় মোট ৪৭ হাজার ৮৪০ কিলোমিটার লাইন নির্মাণের জন্য মালামাল সংগ্রহের ব্যয় পাঁচ হাজার ৮৭৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আর নির্মাণকাজ বাবদ ৭৪৫ কোটি সাত লাখ ৫৬ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। প্রতি কিলোমিটার লাইন নির্মাণ বা আপগ্রেডেশনের জন্য মালামাল বাবদ ব্যয় ১২ লাখ ২৮ হাজার টাকা এবং নির্মাণকাজের জন্য ব্যয় এক লাখ ৫৬ হাজার টাকা পড়ছে। কিন্তু পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের আওতায় বাস্তবায়নাধীন পল্লী বিদ্যুতায়ন সম্প্রসারণের মাধ্যমে ১৫ লাখ গ্রাহক (পরে সাড়ে ১৯ লাখ) সংযোগ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে লাইন নির্মাণের জন্য মালামাল সংগ্রহে ব্যয় ১১ লাখ ৪২ হাজার টাকা এবং নির্মাণকাজের জন্য ব্যয় এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতি কিলোমিটারে লাইন নির্মাণে এ ধরনের ব্যয়ের পার্থক্য সম্পর্কে সংস্থার কাছে শিল্প শক্তি বিভাগ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।

অন্য দিকে বৈদ্যুতিক পরামর্শক সেবা খাতেও ব্যয় গড়ে প্রতি প্রকল্পে ১২ কোটি টাকার বেশি বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রকল্প-১ রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ভৌত কাজ অক্টোবর পর্যন্ত ৪৮ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। তবে অর্থ ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ৬৫ কোটি ২৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকা বা ৪৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। প্রকল্প-২ ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগের ভৌত কাজ ৫১ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। আর টাকা ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ৫৩৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বা ৪২ দশমিক ২০ শতাংশ।

শিল্প ও শক্তি বিভাগ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ৩৫ মাসে যেখানে অগ্রগতি মাত্র অর্ধেক সেখানে আরো ২৪ মাসে বাকি অর্ধেক বাস্তবায়ন কী করে সম্ভব হবে। বিভাগটি বলছে সংশোধিত প্রস্তাবনায় বিতরণ লাইন, উপকেন্দ্র নির্মাণের সংখ্যা ও উপকেন্দ্রের অতিরিক্ত ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব ডিজাইন করার সময় যথাযথভাবে পরিচালিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রাক্কলন করা হয়নি। বিতরণ লাইন নির্মাণের ভৌত পরিমাণ বৃদ্ধির হারের তুলনায় এ বাবদ মালামাল সংগ্রহের ব্যয় বৃদ্ধির হার বেশি। সমজাতীয় প্রকল্পের সাথে তুলনা করে প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন করা দরকার। সেটা করা হয়নি।

এই জ্বালানি ব্যয় ও গাড়ি না কেনার ব্যাপারে আরইবির প্রধান প্রকৌশলী আহসান হাবীবের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, প্রকল্পের গাড়ি কেনা না হলেও কাজ তো থেমে নেই। প্রকল্পের কাজ যারা করছেন তারা রাজস্ব খাতের গাড়ি ব্যবহার করছেন। সেটার জ্বালানি এই প্রকল্প থেকে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্পের মালামাল পরিবহনে জন্য ক্রেনসহ বেশ কিছু যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হচ্ছে। সেগুলোর তেলও এই প্রকল্প থেকে নেয়া হচ্ছে।

গাড়ি কেনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি হয়েছে ২০১৫ সালে। তখন যে দর ধরা হয়েছিল তা দিয়ে গাড়ি কেনা যায়নি। কারণ দাম বেশি। তাই ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে এই খাতে ব্যয় সংশোধন করে। তিনি বলেন, আমি জোর গলায় বলতে পারি আরইবিতে কোনো ধরনের অনিয়ম নেই।

প্রকল্পে গাড়ি ছাড়া জ্বালানি খরচের ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানান, প্রকল্পে গাড়ি না থাকলে কেন জ্বালানি খাতে ব্যয় হবে। যার গাড়িই নেই তার কেন জ্বালানি ব্যয় হবে। এটা ঠিক না। আপনি যেভাবে বললেন সেটা যদি হয়, এটাকে অবশ্যই খারাপভাবে দেখছি। কেন এটা হবে? তিনি বলেন, পিইসির এসব বিষয় আমার কাছে আসে না। পিইসি সভা শেষে প্রকল্প চূড়ান্ত হলে তার পর আমার কাছে আসে। তিনি বলেন, পিইসির এ ধরনের কোনো অবজারভেশন থাকলে সচিব অবশ্যই দেখবেন। তিনি বলেন, পিইসির ফাইল মন্ত্রীর কাছে আসার নিয়মই নেই।

বার্তাবাজার/ডব্লিওএস

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর