অটিস্টিক শিশুকে দত্তক নেয়ার হৃদয় কাঁপানো গল্প

আমাদের জীবনে অনেক বড় একটা জায়গা জুড়ে রয়েছে ‘সমাজ’ শব্দটি। এই শব্দটি বাদ দিয়ে আমরা হয়ত একটা দিনও পার করি না। যা কিছুই করি না কেন আগে ভাবতে হয় মানুষ কি বলবে, এই মানুষগুলোই আসলে সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে এটি সত্য যে সমাজকে বাদ দিয়ে আপনি চলতে পারবেন না। কারণ এই সমাজ আপনাকে স্বীকৃতি প্রদান করে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার। আর ‘মানুষ সামাজিক জীব’ এই কথাটি তো সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি আমরা।

কি ভাবছেন আমি সমাজ সম্পর্কে জ্ঞান দিতে এসেছি আজ? আসলে না, এসেছি অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে। মাতৃত্বের অনেক গল্প আমরা বিভিন্ন সময়ে শুনে থাকি কখনো পিতৃত্বের গল্প শুনেছেন? আজ বলতে চাই এমনই এক ব্যক্তির গল্প যিনি ছিলেন অনেকাংশে সমাজের এই প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে যাওয়া ও পিতৃত্বের এক অসাধারণ উদাহরণ সম্পন্ন একজন মানুষ। আসলে এটিকে শুধু গল্প বললে ভুল হবে। এটি একটি জীবন্ত অনুপ্রেরণার গল্প।

চলুন জেনে নেয়া যাক সমাজের বিরুদ্ধে যাওয়া সেই ব্যক্তিটির গল্প-

ভারতের ইন্দোরে বাবার জন্মদিন উপলক্ষে অনাথ আশ্রমে মিষ্টি বিতরণ করতে গিয়েছিলেন আদিত্য তিওয়ারি। তিনি নিজেও হয়ত জানতেন না যে তার সঙ্গে কি ঘটতে যাচ্ছিলো বা তার জীবন বদলাতে যাচ্ছিলো। বাচ্চাদের মিষ্টি বিতরণের সময় খেয়াল করলেন এক কোণে একটি বাচ্চাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে কিন্তু তার প্রতি ছিলনা কারো কোনো খেয়াল।

কিছুটা কৌতুহল নিয়েই বাচ্চাটির কাছে যান তিনি। বাচ্চাটির নাম অভিনাশ। সেখানে গিয়ে তাকে কোলেও তুলে নেন আদিত্য। শিশুরা ভালবাসা বোঝে কথাটি আসলেই সত্য। পাঁচ মাসের একটি শিশু কারো কোলের পরশ পেয়ে হয়ত খুশিই হয়েছিল। তাইতো কোলে ওঠার পর সেও হাসছিল। আদিত্য তার সঙ্গে খেলা করলো এবং হয়ত তখনই অভিনাশের মায়ায় বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন তিনি।

অনাথ আশ্রমের এক কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলতে গেলেন আদিত্য। জানতে চাইলেন আশ্রমের শিশুদের ভবিষ্যত কি? আর কি হবে তাদের সঙ্গে, সেখানে তিনি অভিনাশের ব্যাপারেও জানতে চাইলেন।

কর্মচারী তাকে জানালেন আশ্রমের সব শিশুদের কেউ না কেউ দত্তক নিবে। কিন্তু অভিনাশকে কেউ হয়ত নিবে না। কারণ অভিনাশ সাধারণ শিশুদের মত নয়, সে একজন বিশেষ শিশু যাকে আমরা সাধারণত প্রতিবন্ধী বলে থাকি।

জন্মের পর থেকেই ‘ডাউন সিনড্রোম’ নামক রোগে ভুগছে অভিনাশ। তাই তার খেয়াল আর দশটি সাধারণ শিশুর মত নেয়া হয়না বা তাকে সাধারণ শিশুদের তালিকায় গণ্যও করা হয়না।

ঠিক সেই মুহুর্তে আদিত্য ঠিক করে যে সে অভিনাশকে দত্তক নিতে চায়। কিন্তু আমরা সবকিছু যতটা সহজে আশা করি সাধারণত ততটা সহজে অর্জন করতে পারিনা। আদিত্যের ক্ষেত্রেও ভিন্ন কিছু ঘটেনি। অভিনাশ’কে দত্তক নিতে চাওয়ার মুহুর্ত থেকেই এক কঠিন পরীক্ষা শুরু হয় আদিত্যের।

তিনি অনাথ আশ্রম কর্তৃপক্ষ’কে যখন তার ইচ্ছার কথা জানায় তারা অভিনাশকে দত্তক দিতে রাজি হয়নি। রাজি না হওয়ার জন্য তাদের কাছে অনেক কারণ ছিল। যা মানতে বাধ্য ছিল আদিত্য। কিন্তু তিনিও হার মানতে নারাজ ছিল।

আশ্রম থেকে তাকে বলা হয় ভারতীয় আইন অনুযায়ী ৩০ বছরের নিচে একটি শিশুকে দত্তক নেয়ার নিয়ম নেই দেশটিতে। সুতরাং আদিত্য অভিনাশকে দত্তক নিতে পারবে না। এছাড়া আদিত্য একজন অবিবাহিত যুবক।

এ সবকিছুর মাঝে সমাজ, আত্মীয়-স্বজন এদের কটুকথা ও সন্দেহযুক্ত প্রশ্নগুলো ছিল অন্যতম। একজন অবিবাহিত ছেলে বাচ্চা দত্তক নিতে চায় তাও আবার একটি অস্বাভাবিক বাচ্চাকে! এর পিছনে কত মানুষের কত যুক্তি ছিল তার হিসেব নেই। নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে সবাই নিজের মত যুক্তি দাড় করিয়েছিল। কারো কারো প্রশ্ন ছিল, আদিত্য মেডিক্যালি সুস্থ তো? আদিত্য স্বাভাবিক তো? বাচ্চাটা তার নিজের না তো, যাকে লুকিয়ে রেখে এখন দত্তকের মাধ্যমে সমাজে স্বীকৃতি দিতে চায়?

কিন্তু এসব কথা বা আশ্রমের প্রত্যাখ্যান কোনোটিই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি আদিত্যের ইচ্ছা শক্তি ও ৫ মাসের অভিনাশের প্রতি তার ভালোবাসার মধ্যে। আদিত্য জানতেন না যে তিনি কি করবেন শুধু জানতেন যে তিনি হার মানবেন না।

আদিত্য প্রায় অনাথ আশ্রমে যেতেন সেখানে তিনি অভিনাশের সঙ্গে সময় কাটাতেন। ওর সঠিকভাবে চিকিৎসা করানো হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে খোঁজ নিতেন। এরপর তিনি অভিনাশের চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র ও ওর মেডিকেল রিপোর্ট চাইতে শুরু করেন আশ্রম কর্মচারীদের কাছে। কিন্তু তারা কখনো সেসব কাগজ দেয়নি।

এরপর তারা আদিত্যের আগ্রহে বিরক্ত হয়ে অভিনাশ’কে ভোপালের একটি অনাথআশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। আদিত্য অভিনাশের জন্য সেখানেও থাকতে চেয়েছে। কিন্তু তারা রাজি হয়নি।

আদিত্য কখনো বিরক্ত হয়নি। প্রতি সপ্তাহে অভিনাশের সঙ্গে দেখা করতে তিনি সেখানে যেতেন এবং এসবের মাঝে ভারতে বাচ্চা দত্তক নেয়ার আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করেন।

দত্তক নেয়ার জন্য তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরে চিঠি-মেইল পাঠাতে শুরু করেন। এরমধ্যে তিনি চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। সেখানে তিনি জানতে পারেন যে অভিনাশ নামের শিশুর সম্পর্কিত কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।

এই ব্যাপারটি তার মাথায় আটকে যায়। তিনি বুঝতে শুরু করেন যে আশ্রমে বিনা কাগজপত্রে অনেক শিশু ছিল। যাদের নাম রেজিস্টার্ড ছিল না এবং সেখান থেকে অনেক শিশু উধাও হয়ে যাচ্ছিল। তখন তিনি ধারণা করেন হয়ত ওই আশ্রমটি কোনো ধরণের ‘শিশু পাচার’ বা ‘অঙ্গ বিক্রয়’ এই ধরণের কাজের সঙ্গে যুক্ত।

আদিত্য চাচ্ছিলো না যে অভিনাশ বা আশ্রমের অন্য কোনো শিশুর সঙ্গে খারাপ কিছু হোক তাই তিনি এসব বিষয়ে বিভিন্ন থানায় পুলিশকে অবগত করেন ও সত্য উদঘাটনের জন্য অভিযোগ করেন। কিন্তু এরপর তিনি বিভিন্ন বিপদের সম্মুখীন হতে শুরু করে যেমন, বিভিন্নভাবে তাকে ধমকানো হয় যাতে তিনি আশ্রমের থেকে দূরে থাকেন অন্যাথায় তার সঙ্গে খুব খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে।

এসব কোনো কিছুই আদিত্যকে আটকায়নি। তার আশা অবশেষে কিনারা খুঁজে পায় যখন ভারতের কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে তার চিঠির উত্তর দেয়া হয় ও তাকে সাহায্য করার আশ্বাস দেন তারা।

এরপর সেখান থেকেই বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আশ্রমটির সত্য উদ্ঘাটন করে সেটির আসল সত্য সবার সামনে উন্মোচিত করা হয়। সবশেষে আশ্রমটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

অবশেষে আদিত্যের জীবনে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহুর্তটি আসে যখন অভিনাশকে দত্তক নেয়ার জন্য তাকে আইনিভাবে হ্যাঁ বলা হয়। দীর্ঘ ১১ মাস চেষ্টার সফলতা পান তিনি এবং অভিনাশকে তার বাড়িতে নিয়ে যান।

এসব কথা অভিনাশ ‘হিউম্যান্স অব বোম্বে’ নামক একটি ফেসবুক পেইজে শেয়ার করেন যেখান থেকে ঘটনাটি হাজারো মানুষের দৃষ্টি কাড়ে। এর পূর্বে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তার এই অর্জনের জন্য তাকে প্রশংসিত করা হয়।

ভারতের ‘সর্বকনিষ্ঠ সিঙ্গেল বাবা হিসেবে অটিস্টিক শিশুকে দত্তক নেয়ার জন্য ইন্ডিয়া বুক অব রেকর্ডসয়ে নাম লিখিয়েছেন তিনি।

অভিনাশ এখন প্লে-স্কুলে যায়। বাবা এবং মা হিসেবে সে আদিত্যকেই চিনে। আদিত্যের পরিবারও ভীষণ খুশি অভিনাশকে পেয়ে। বর্তমান পৃথিবীতে যেখানে কিছু মমত্বহীন ও বিবেকহীন মানুষ নিজ বাচ্চাকেও ডাস্টবিনে ফেলে দিতে দ্বিধাবোধ করে না সেখানে আদিত্যের এই কাজটিকে অসাধারণ বলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা আমি। কোনো রূপকথার গল্প বা সিনেমার হিরো না হয়েও আদিত্য একজন জীবন্ত কিংবদন্তী হয়েছেন। তিনি বাস্তব জীবনের হিরো। যে সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়েও মানবতা ও ভালবাসার জন্য লড়তেও জানে এবং বিজয় অর্জন করতেও জানে।

বার্তাবাজার/কে.জে.পি

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর