রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ: বিচার চাওয়াই ভুল ছিল

বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের মামলার বিচার চাওয়াই ভুল ছিল বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এক তরুণীর মা। সাক্ষী দেওয়া নিয়ে হয়রানির অভিযোগ তুলে সোমবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় তিনি এ অভিযোগ করেন।

গতকাল আসামিপক্ষের আইনজীবী অসুস্থ থাকায় ধর্ষিতার জেরা পিছিয়ে আগামী ৬ মে ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

অন্যদিকে ধর্ষিতাদের পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ মনে করেন, আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা হিসেবে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হলে এতদিনে বিচার শেষ হয়ে যেত।

গতকাল মামলাটিতে একজন ধর্ষিতাকে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের জেরার জন্য দিন ধার্য ছিল। এ উদ্দেশ্যে আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। আসামি নাঈম আশরাফের কাছে ধর্ষিত ভিকটিমও সাক্ষ্য দিতে মায়ের সঙ্গে হাজির হন আদালতে।

কিন্তু আসামি নাঈম আশরাফের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান অসুস্থ মর্মে অন্যান্য আসামিদের আইনজীবীরা সময় প্রার্থনা করেন। কারণ হিসেবে বলেন, আসামি নাঈম আশরাফের পক্ষে জেরা চলমান। তার জেরা শেষ না হলে অন্য আসামিদের পক্ষে জেরা করা সমীচীন হবে না।

তখন ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. খাদেম উল কায়েশ কাঠগড়ায় থাকা ভিকটিমের কাছে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কবে আসতে পারবেন।’ জবাবে ভিকটিম ‘যেকোনো বৃহস্পতিবার’ তারিখ ধার্যের কথা বলেন।

উপস্থিত এক আইনজীবী জানান, ১৫ দিনের আগে আইনজীবী মাহবুবুর রহমান সুস্থ হবেন না। ভিকটিমের মা বলেন, ‘তিনি ৫ তারিখের পর ২০ দিন আসতে পারবেন না।’ সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে বিচারক ৬ মে দিন ধার্য করেন।

ট্রাইব্যুনাল থেকে ভিকটিমকে নিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভিকটিমের মা বলেন, ‘আমাদের বিচার চাওয়াই ভুল ছিল। আজ ছয় দিন মেয়েকে নিয়ে ট্রাইব্যুনালে আসলাম, তার মধ্যে তিন দিন বিচার কাজ হয়েছে, আর তিন দিন ফিরে গেলাম। এ ছাড়া আরও দুই-তিন দিন এমনিই আসতে হয়েছে।

এ হয়রানি আর ভালো লাগছে না। মেয়েটি সম্প্রতি একটি চাকরিতে ঢুকেছে। আমি নিজেও উত্তরবঙ্গে একটি কলেজে চাকরি করি। এভাবে বারবার আসা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণেই মানুষ বিচার চায় না।’

এদিকে ভিকটিমদের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফারুক আহমেদ বলেন, আলোচিত মামলা হিসেবে সরকারের উচিত ছিল মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো। তাহলে এতদিন মামলাটির বিচার শেষ হয়ে যেত। সাক্ষীদেরও এভাবে হয়রানির শিকার হতে হতো না।

মামলার নথি থেকে দেখা যায়, মামলাটিতে ২০১৭ সালের ১৩ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন হয়। এরপর প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য হয় ওই বছর ২৪ জুলাই। ওইদিনসহ চারটি ধার্য তারিখের পর ওই বছর ১৬ অক্টোবর আসামি সাফাত আমদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার ভিকটিমের সাক্ষ্য শুরু হয়।

ওই চারটি তারিখের মধ্যেও দুদিন ভিকটিম এসে ফিরে যায়। ১৬ অক্টোবর থেকে ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত আটটি ধার্য তারিখে জেরা ও জবানবন্দির পর ওই ভিকটিমের সাক্ষ্য শেষ হয়।

এরপর ওই বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি ও ১৪ মার্চ কারাগার থেকে আসামি না আনায় সাক্ষ্য হয়নি। এরপর ওই বছর ২৭ মার্চ ২২ এপ্রিল পর্যন্ত তিনটি ধার্য তারিখে রেইনট্রি হোটেলের ১০জন কর্মচারীরসহ ১১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়। এরপর তিনটি ধার্য তারিখে সাক্ষী না আসায় সাক্ষ্য হয়নি।

সর্বশেষ গত ৯ আগস্ট থেকে আজ ফিরে যাওয়া ভিকটিমের সাক্ষ্য শুরু হয়। ওইদিন জবানবন্দির পর পরবর্তী তারিখ ৭ অক্টোবর আংশিক জেরা হয়। পরবর্তী ধার্য তারিখ ৬ নভেম্বর ভিকটিম না আসায় সাক্ষ্য পেছায়।

এর পরবর্তী দুটি ধার্য তারিখ ১৫ ও ২২ জানুয়ারি একদিন আসামিদের কারাগার থেকে না আনায় এবং একটি আইনজীবী না থাকায় ভিকিটিম ফিরে যান। সর্বশেষ ১৩ ফেব্রুয়ারি ভিকটিমের আংশিক জেরা হয় এবং ৬ ও ১৮ মার্চ ভিকটিম না আসায় সাক্ষ্য পেছায়।

মামলার আসামিদের মধ্যে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ ও সাফাতের বন্ধু নাঈম আশরাফ ওরফে এইচএম হালিম কারাগারে রয়েছেন। আসামি সাফাত আহমেদের বন্ধু সাদমান সাকিব, দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন জামিনে রয়েছেন।

২০১৭ সালের ২৮ মার্চ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে অস্ত্রের মুখে ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই দুই ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে ৬ মে বনানী থানায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন।

মামলায় বলা হয়, আসামিদের মধ্যে সাফাত ও নাঈম দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং তারা ওই দুই ধর্ষিতা ছাত্রীর বন্ধু। গত ২৮ মার্চ ঘটনার দিন আসামি সাফাতের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের যান ওই দুই ছাত্রী।

এরপর ওইদিন তাদের রাত ৯টা থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত আসামিরা আটকে রাখেন। অস্ত্র দেখিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন। জোর করে একটি কক্ষে নিয়ে যায় আসামিরা। আসামি সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ একাধিকবার তাদের ধর্ষণ করেন।

ধর্ষণ করার সময় আসামি সাফাত গাড়িচালক বিল্লালকে দিয়ে ভিডিওচিত্র ধারণ করেন। পরে বাসায় দেহরক্ষী পাঠিয়ে তাদের ভয়ভীতি দেখান। ধর্ষিতরা ভয়ে এবং লোকলজ্জার কারণে এবং মানসিক অসুস্থতা কাটিয়ে উঠে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলোচনা করে তারা মামলার সিদ্ধান্ত নেন।

মামলাটিতে ওই বছর ৭ জুন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এমি আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর