বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা নেই, তবু তিনি সহযোগী অধ্যাপক!

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা ছিল না তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমানের। কিন্তু তিনি এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। ১০ বছর ধরে চেষ্টা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অধ্যাপক হওয়ার। তবে সফল হননি। অধ্যাপক হওয়ার জন্য উচ্চ আদালতে রিটও করেছিলেন তিনি।

তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমানের দাবি, তিনি ঢাকার তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা থেকে ১৯৮৪ সালে দাখিল ও ১৯৮৬ সালে আলিম পাস করেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ‘সরকার ও রাজনীতি’ বিভাগ থেকে ১৯৮৯ সালে স্নাতক এবং ১৯৯০ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেন। পড়াশোনা শেষে তিনি ১৯৯৩ সালের ১৩ নভেম্বর প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে।

জানতে চাইলে টঙ্গীর তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক (অফিসিয়াল ইনচার্জ) মাহতাব উদ্দিন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘১৯৮৪ সালে যারা দাখিল পাস করেছে, তাদের দাখিলের মান দেওয়া হয়নি। সর্বশেষ দাখিলের মান দেওয়া হয় ১৯৮৫ সালে। ১৯৮৪ সালের সনদ দিয়ে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতে পারবেন। অন্য কোথায় এটা সমমান হবে না।’

রাবির সহযোগী অধ্যাপক তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমানের বিষয়টি তুলে ধরলে মাহতাব উদ্দিন বলেন, ‘১৯৮৪ সালের দাখিল পাস দিয়ে কেউ ভার্সিটিতে অনাস-মাস্টার্স করতে পারে না। তখন কামিল পাস করার পর এসএসসি সমমান ধরা হতো। তার কামিল পাসের সনদটাই এসএসসি বলে ধর্তব্য হতো।

যদি তিনি কামিল পাস না করে থাকেন, তাহলে ১৯৮৪ সালের সনদ দিয়ে চাকরি করার যৌক্তিকতা নেই।’ ১৯৮৪ ও ১৯৮৬ সালে দাখিল ও আলিম পাস করা শিক্ষার্থীদের ওই সনদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার বিধান ছিল কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (গোপনীয় শাখা) হোসাইন মাহমুদ ফারুক বলেন, ‘যারা ১৯৮৪ সালে দাখিল পাস করেছে, তাদের আবার বিশেষ একটা পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল।

সেই বিশেষ পরীক্ষায় যারা অংশগ্রহণ করেছে এবং উত্তীর্ণ হয়েছে, তাদেরটা এসএসসির সমমান। আর যদি পরীক্ষা না দিয়ে থাকে বা উত্তীর্ণ না হয়ে থাকে তাহলে তার অষ্টম শ্রেণির মান হবে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না।’

দাখিল ও আলিম পাসের পর ওই বিশেষ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমান জানান, তিনি দাখিল পরীক্ষার পর কোনো বিশেষ পরীক্ষায় অংশ নেননি।

দাখিল ও আলিমের সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসির সমমান প্রসঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হোসাইন মাহমুদ ফারুক বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ১৯৮৫ ও ১৯৮৭ সালে দাখিল ও আলিম পাস করা শিক্ষার্থীদের এসএসসি ও এইচএসসির সমমান দেওয়া হয়েছে।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমান জানান, তিনি বৈধভাবেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেধা তালিকা থেকে ভর্তির সুযোগ পান। পরে সেখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এতে যদি কোনো নিয়মের ঘাটতি থাকে তাহলে তার জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী, তিনি নন।

‘অবৈধ’ সনদ দিয়ে কীভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমান জানান, ওই সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি নোটিশ পত্রিকায় দেখার পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ডেপুটি রেজিস্ট্রার (অ্যাকাডেমিক)-এর কাছে যান। তার আশ্বাসেই ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে তিনি ‘সরকার ও রাজনীতি’ বিভাগে ভর্তি হন।

১২ বছরে দাখিল পাস

তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমানের দাখিল পাসের সনদে দেখা যায়, তার জন্ম তারিখ ২৫ জানুয়ারি ১৯৭২। তিনি ১৯৮৪ সালের ১৫ জুলাই দাখিল পাস করেন। সেই হিসেবে তিনি দাখিল পাস করেন মাত্র ১২ বছর ৫ মাস ২১ দিনে।

টঙ্গীর তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক (অফিসিয়াল ইনচার্জ) মাহতাব উদ্দিন জানান, ১৯৮৫ সালের আগে ১১ বছরেও দাখিল পাস করেছে অনেকে। কেননা ওই সময়ে এখনকার মতো দাখিলকে এসএসসির সমমান ধরা হতো না। তাই যেকেউ চাইলে দাখিল পাস করতে পারত।

যেভাবে সামনে এলো তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমানের ‘অবৈধ’ সনদ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমানের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি বোর্ডে তার দাখিল পাসের সনদটি প্রথম নজরে আসে। ওই নিয়োগ বোর্ডে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন-অর-রশিদ।

বিষয়টি তার নজরে আসায় বিভাগকে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন তিনি। কিন্তু ওই সময়ে বিভাগের একজন আওয়ামীপন্থী শিক্ষককে ‘ম্যানেজ’ করে সেই জালিয়াতি চাপা দেন তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমান। পান পদোন্নতিও।

শিক্ষকরা আরও জানান, বিএনপি-জামায়াতের সময়ে নিয়োগ পাওয়া তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমানের দাখিলের ‘অবৈধ’ সনদের বিষয়টি আবার সামনে আসে ২০০৯ সালে। ওই বছর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর উপাচার্যের দায়িত্ব পান অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান।

তার সময়ে বিভাগে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য আবেদন করেন তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমান। কিন্তু তার ওই সনদসহ অনেক খবর তখন বিভাগের প্লানিং কমিটির কাছে যায়। পরে তারা সর্বসম্মতভাবে সহযোগী অধ্যাপক তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমানের অধ্যাপক হওয়ার আবেদনপত্রে সুপারিশ না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

যেকোনো শিক্ষকের সরাসরি বা পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার সময় প্রার্থীর সনদসহ যাবতীয় কাগজপত্র বিভাগ তথা প্লানিং কমিটি যাচাই করে থাকে। প্লানিং কমিটি প্রার্থীর যেসব কাগজপত্র অনুমোদন করে পাঠায়, সেগুলো সঠিক বলেই উচ্চতর কর্তৃপক্ষ ধরে নেয়। তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমানের দাবি, ২০০৯ সালে তার অধ্যাপক হওয়ার কথা। কিন্তু বিভাগের কিছু ‘মন্দ লোক’ সেটা হতে দিচ্ছে না।

অধ্যাপক হওয়ার জন্য বিভাগে আবার আবেদন

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য কিছু দিন আগে আবার আবেদন করেছেন তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমান। তার বিষয়ে বিভাগে প্লানিং কমিটিও হয়েছে। অধ্যাপক হওয়ার ক্ষেত্রে তার ‘সব যোগ্যতা রয়েছে’ জানিয়ে তার ফাইল রেজিস্ট্রার দপ্তরে পাঠিয়েছেন বিভাগটির সভাপতি অধ্যাপক এক্রাম উল্যাহ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক এক্রাম উল্যাহ বলেন, সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমানের সব যোগ্যতা রয়েছে। তাই প্লানিং কমিটির মাধ্যমে তার ফাইল রেজিস্ট্রার দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমানের ‘অবৈধ’ সনদের বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি বলেন, সেটা দেখার বিষয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও তারেক মুহম্মদ তওফীকুর রহমানকে যারা নিয়োগ দিয়েছেন তাদের। সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হওয়ার যোগ্যতায় এসব বলা নেই।

বার্তাবাজার/কেএ

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর