আমি কি বাঁচবো? আইসিইউতে চিকিৎসাধীন নুসরাতের প্রশ্ন

আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি কী সুস্থ হবো? আমি কি বাঁচবো? ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন নুসরাত জাহান রাফি ক্ষীণ কণ্ঠে এভাবে প্রশ্ন করছেন স্বজনদের।

তার সঙ্গে থাকা স্বজনরা জানিয়েছেন তার এমন প্রশ্নে কান্না চেপে রাখতে পারেন না তারা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন রাফির অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। পরিস্থিতি যেকোনো দিকে মোড় নিতে পারে। এদিকে নুসরাত জাহান রাফির উন্নত চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চিকিৎসার জন্য নয় সদস্যের বোর্ড গঠন করেছে বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

অভিযুক্ত মাদ্রাসা অধ্যক্ষকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বার্ন অ্যান্ড পাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন জানিয়েছেন, ছাত্রীর গায়ে আগুন দিয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মর্মাহত ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গতকাল দুপুরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে দেখা করতে যান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাকে এ ঘটনায় উদ্বেগের কথা জানান। ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফেনীর ওই ছাত্রীর সার্বিক দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি তার চিকিৎসাসহ সার্বিক বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারে সংশিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা মেয়েটির চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি। তার অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক।

ওই ছাত্রীর চিকিৎসার বিষয়ে ডা. আজাদ জানান, বোর্ডের সদস্যরা আইসিইউতে গিয়ে দুবার পর্যবেক্ষণ করেছেন। তার গলা থেকে শরীর, দুই হাত, পা সব জায়গা পুড়ে গেছে। পাশাপাশি তার শ্বাসনালিও পুড়ে গেছে। অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হলে দু-একদিনের মধ্যেই অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা হলেন-ঢামেক বার্ন ইউনিটের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. রায়হানা আউয়াল, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. মহিউদ্দিন আহমেদ, প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ নওয়াজেস খান, একই বিভাগের অধ্যাপক ডা. লুৎফর কাদের লেনিন, অধ্যাপক ডা. বিধান সরকার, ডা. নজরুল ইসলাম ও ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবির।

যা বললেন রাফির স্বজনরা: গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, রাফি আমাদের ইতোমধ্যে জানিয়েছে তাকে হাত পা বেধে গায়ে আগুন দেয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে এসময় বোরকা পড়া ৪ জনের মধ্যে দুজন নারী ও দুজন পুরুষ ছিল। অন্যান্য দিন আমাকে পরীক্ষার কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হলেও ওই দিন ঢুকতে দেয়া হয়নি। অভিযুক্ত প্রিন্সিপাল এসএম সিরাজ উদ দৌলা শুধুমাত্র আমার বোনের শ্লীলতাহানীর চেষ্টা করে ক্ষান্ত হননি। এর আগে আরো অনেক শিক্ষার্থীর সাথে এমনটা করেছেন। কিন্তু কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করেনি। কেউ কেউ প্রতিবাদ করেও ন্যায় বিচার পায়নি। কারন তার মদতপুষ্ট একটি বিশাল গ্যাং বাহিনী রয়েছে। যাদেরকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা বিশেষ করে পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র দেয়া থেকে শুরু করে নানান সুযোগ সুবিধা প্রদান করে থাকেন।

তিনি বলেন, গত ২৭শে মার্চ সকাল ১১ টায় মাদ্রাসার পিয়ন নুরুল আমিন রাফিকে প্রিন্সিপালের কক্ষে ডেকে নিয়ে যায়। এসময় তার সাথে আরো দুজন সহপাঠী ছিল। কিন্তু তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এসময় প্রিন্সিপাল পিয়নকে বলেন কেউ যেন ভেতরে না আসতে পারে। পিয়ন রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। প্রিন্সিপাল তার চেয়ার থেকে উঠে আলিম পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সরবরাহ করার বিনিময়ে কুপ্রস্তাব দেন। রাফি এই কুৎসিত প্রস্তাব নাকচ করে রুম থেকে বের হতে চাইলে প্রিন্সিপাল জোরপূর্বক তার শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেন।

এসময় আমার বোন রাফি চিৎকার করে কোনো মতে রুম থেকে বের হয়ে প্রিন্সিপালের রুমের সামনেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তার একজন সহপাঠী একই মাদ্রাসার দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আমার ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হানকে ফোন করে এ বিষয়ে জানায়। পরবর্তীতে আমি ও আমার মা মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আমাদের হুমকি দেন। বলেন, এই ঘটনা কাউকে জানালে কিংবা মামলা করলে আমাদের তিন ভাই বোনকেই মাদ্রাসা থেকে রেড টিসি দিয়ে বের করে দেয়া হবে। এসময় প্রিন্সিপাল উল্টো আমাদের অপবাদ দিয়ে পুলিশে খবর দেন। শনিবার সকালে মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর আফসার উদ্দীন আমাকে ফোন দিয়ে মামলা শেষ করবো কি না জানতে চান।

আমরা রাজি না হলে তিনি ফোন কেটে দেন। সকাল ৯টায় রাফিকে নিয়ে আমি পরীক্ষার কেন্দ্রে যাই। আমি মাদ্রাসার ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে দারোয়ান মোস্তফা বাঁধা দেয়। বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও আমাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি। এমনকি কেন্দ্রে ডিউটিরত পুলিশকেও বলে দেয়া হয় আমি যেন ভেতরে প্রবেশ করতে না পারি। রাফি মাদ্রাসার ভেতরে প্রবেশের কিছুক্ষণ পরে নিকাব পড়া এক ছাত্রী এসে বলে, উপর তলায় তোমার বান্ধবী নিশাতকে মারধর করা হচ্ছে। এ কথা বলে তাকে দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যায়। ওখানে গিয়ে রাফি দেখতে পায় এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। যে চারজন নিকাব পড়া ছিল তাদের প্রত্যেকের হাতে মোজা ও চোখে কালো চশমা পড়া ছিল। এসময় তারা রাফিকে ঘিরে ফেলে। তারা প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিতে বলে। আমার বোন এতে রাজি না হওয়ায় তারা এক পর্যায়ে রাফির শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। রাফির চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে পানি দিয়ে আগুন নিভানোর চেষ্টা করে। পরবর্তীতে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
রাফির বাবা একে এম মুসা বলেন, আমার মেয়েকে যারা আজ এই অবস্থা করেছে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। এক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, প্রশাসনসহ সকলের সদয় সাহায্য প্রর্থনা করছি। তারা যেন আমার মেয়ে হত্যা চেষ্টাকারীর সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করেন।

সোনাগাজী পৌরসভার মেয়র এডভোকেট রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, প্রিন্সিপাল ওখানে বালাখানার মতো অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছেন। ইতোপূর্বে আরো অনেক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে। সম্প্রতি আরেক মাদ্রাসার শিক্ষার্থী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও সে তা প্রমাণ করতে পারেনি। যদিও সে রাফির সাথে একত্রে থানায় গিয়ে প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়।

সূত্র: মানবজমিন।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর