বিভাজনের রাজনীতিকেই নিজের হাতিয়ার করেছেন নেতানিযাহু

১৯৮২ সাল। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে এলেন এক তরুণ কূটনীতিক। অপেক্ষারত সাংবাদিকদের প্রশ্ন, আর ক্যামেরার ফ্লাশের ঝলকানির মধ্যেও অপ্রতিভ ও হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ওই তরুণ। মুখে কোনো কথা নেই। আদতে ভেতরে যেভাবে নাজেহাল হয়েছেন, তা এড়াতে শব্দের সংকটে ভুগছেন তিনি।

সেদিনের সেই হতবিহ্বল তরুণ কূটনীতিকই আজকের ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, যিনি পুনর্নির্বাচনের ক্ষণ গুনছেন। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নেতানিয়াহু পরিণত হয়েছেন এক চতুর রাজনীতিকে, যাকে দুর্নীতির অকাট্য অভিযোগ নিয়েও আর নাজেহাল করতে পারেন না সাংবাদিকেরা।

ফিলিস্তিনিদের নিষ্পেষণে, ইসরায়েলের দখলদারি বজায় রাখতে ইসরায়েল গত এক দশকে এতটাই চাতুর্য ও সামরিক শক্তির পরিচয় দিয়েছে যে, নেতানিয়াহুকে এখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী নেতা হিসেবে গণ্য করা হয়। গত এক দশক ধরে ইসরায়েলকে তিনি শুধু নিরাপদও রাখেননি, তুলনামূলক বৈরী প্রতিবেশীদের সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। আর এই সবই তিনি করতে পেরেছেন দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে।

১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া নেতানিয়াহু সরকারি চাকরিতে যোগ দেন ১৯৬৭ সালে, ঠিক যে বছর আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে বেশ কিছু আরব অঞ্চল ইসরায়েলের দখলে আসে। নেতানিয়াহু যোগ দিয়েছিলেন ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীতে। তাঁর পদায়ন হয় বিশেষ ইউনিটে। সামরিক বাহিনীতে তিনি ক্যাপ্টেন পদ পর্যন্ত পদোন্নতি পান। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে পড়াশোনা শেষে তিনি বোস্টন পরামর্শক গ্রুপে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে যোগ দেন।

সেনাবাহিনীতে থাকাকালে বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন নেতানিয়াহু। ছিলেন সুয়েজ খাল অপারেশন ও ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে। বোস্টন পরামর্শক গ্রুপের কাজ ছেড়ে ইসরায়েলে ফিরে আসেন ১৯৭৮ সালে। দেশে ফিরে তিনি যুদ্ধে নিহত ভাই ইয়োনাতানের নামে একটি সন্ত্রাসবিরোধী সংগঠন গড়ে তোলেন। একই সময়ে ফেরেন আবার সরকারি চাকরিতে।

শুরুতে যে ঘটনার কথা বলা হয়েছে, তা নেতানিয়াহুর ওয়াশিংটনে উপরাষ্ট্রদূত থাকাকালের ঘটনা। সে সময়ের তরুণ নেতানিয়াহুর সঙ্গে এখন পোড় খাওয়া রাজনীতিক নেতানিয়াহুর মিল খুব কমই আছে। কারণ এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কম অভিজ্ঞতা অর্জন করেননি। এর মধ্যে ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন উল্লেখযোগ্য। এই পদে তিনি চার বছর দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৮ সালে দেশে ফিরে যখন তিনি ইসরায়েলি আইনসভা ‘নেসেট’-এর আসন পেতে নির্বাচন করছেন, তখন সংবাদমাধ্যম তাঁর বাকপটুতায় মুগ্ধ। সেদিনের সেই বিহ্বল তরুণটি তখন শুধুই অতীত। ১৯৯৩ সালে তিনি লিকুদ পার্টির নেতা হয়ে ওঠেন। এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তিনি এতটাই বাকপটু হয়ে ওঠেন যে,১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ঠিক আগের বছর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন গুপ্তহত্যার শিকার হন। এ ঘটনাই ইসরায়েলের পরবর্তী সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতানিয়াহুকে সামনে নিয়ে আসে।

১৯৯৯ সালে নির্বাচনে হেরে গেলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ২০০২ সালেই দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকে। এই যে অপরিহার্যতা তিনি তৈরি করেছেন ইসরায়েলের রাজনীতিতে তাই তাঁকে ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে, যেখানে তিনি এখনো আছেন।

পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতানিয়াহু বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টি ও ইসরায়েলের লিকুদ পার্টির মধ্যে সম্পর্ক এতটাই গভীর যে, তাকে পৃথক করে দেখাটাই মুশকিল।

এটা কেউ ভাবতেই পারে না যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নেতানিয়াহুর কোনো দূরত্ব থাকতে পারে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় গত ২৪ মার্চ ওয়াশিংটন সফরের সময় নেতানিয়াহুর পাওয়া অভ্যর্থনায়, যা অনেক রাষ্ট্রনেতার পক্ষেই কল্পনা করা কঠিন।

আর সর্বশেষ ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের দখল করা সিরীয় গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলি অধিকারকে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে স্বীকৃতি দিল, তাতে বরং দেশটির আরব প্রতিবেশীরা শঙ্কিতই হতে পারে। দুজনের মধ্যে অবশ্য বড় একটি মিল রয়েছে। আর তা হলো বিভাজনের রাজনীতিই তাদের মুখ্য অস্ত্র।

নেতানিয়াহু শুরু থেকেই বিভাজনের রাজনীতিকেই নিজের হাতিয়ার করেছেন। এটিই তাঁর সাফল্যের সূত্র। আন্তর্জাতিক কূটনীতির অভিজ্ঞতাই হয়তো তাঁকে এ শিক্ষা দিয়েছে। ১৯৯৩ সালে লিকুদ পার্টির প্রধান হওয়ার পর থেকেই তিনি এ বিভাজনের খেলাটি খেলছেন। আর খেলছেন নিরাপত্তার খেলা। ১৯৯৩ সালে আইজ্যাক রবিন যখন অসলো চুক্তি করে এলেন, লিকুদ পার্টির নতুন এ নেতা তখন প্রধানমন্ত্রীকে অভিযুক্ত করলেন ‘নিজের দেশের সঙ্গে বেইমানির’ জন্য।

রবিন গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হলে, এই নিরাপত্তার বুলিটি স্বাভাবিকভাবেই আরও প্রবল হয়। সে সময় লেবার পার্টির নেতা হিসেবে দায়িত্ব নেন শীমন পেরেজ। ১৯৯৬ সালে আসন্ন নির্বাচনেও পেরেজই এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু ভোটের ঠিক আগে আগে সন্ত্রাসী হামলা হলে বদলে যায় দৃশ্যপট, যা ক্ষমতায় নিয়ে আসে নেতানিয়াহুকে। সেই থেকে আজ অবধি তিনি এই নিরাপত্তা ও বিভাজনের খেলাটিই খেলছেন।

এবারও মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট পার্টির নেতা বেন গান্টজকে ঠেকাতে তিনি এই নিরাপত্তার প্রসঙ্গটিকেই প্রধান করে তুলেছেন। ট্রাম্পের মতো তিনিও ‘অভিজাতবিরোধী’ স্লোগান তোলেন ভোটার আকর্ষণের জন্য। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বলার এ কৌশল এখন পর্যন্ত নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প উভয়ের জন্যই কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তবে কে কাকে শিখিয়েছেন, তা ঠিক বলা যাচ্ছে না।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর