বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার মধ্যে মিল-অমিল

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজ ৯৯তম জন্মবার্ষিকী। আগামী বছর জন্মশতবার্ষিকী হবে। জাতির পিতার হাতে গড়া দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ টানা দশ বছর ধরে ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

সবখানে বলা হচ্ছে যে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই আওয়ামী লীগ হাঁটছে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। এটা সত্য যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৭২ থেক ’৭৫-এ বাংলাদেশের যেরূপ পরিবর্তন এঁকেছিলেন, উন্নয়নের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজই করছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সুনির্দিষ্টভাবে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘমেয়াদি যে লক্ষ্যগুলো ছিল সেই লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন এবং বঙ্গবন্ধুর আকাঙ্ক্ষাগুলোকে পরিস্ফুটনের জন্যই কাজ করছে। যেমন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন যে, দারিদ্রমূক্ত বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে দারিদ্রমুক্ত করার কাজ চলছে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশ আত্মনির্ভরশীল হবে, স্বাবলম্বী হবে সে পথেই বাংলাদেশ হাঁটছে। জাতির পিতা চেয়েছিলেন বাংলাদেশ বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভর করবে না। বাংলাদেশের বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরতা কমে এসেছে। জাতির পিতা চেয়েছিলেন বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে।

বাংলাদেশ আজ অসাম্প্রদায়িকতার রোল মডেল হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়েছে। এমন অনেক উদাহরণ দিয়েই বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর যে অসমাপ্ত কাজ সেই কাজের পথেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার হাঁটছে। তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে কিছু অদ্ভুত মিল রয়েছে এবং কিছু অদ্ভুত অমিলও রয়েছে।

প্রথমে দেখা যাক মিলগুলো কী কী

(১) তুখোড় স্মৃতিশক্তি: জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের তুখোড় স্মৃতিশক্তি ছিল। তিনি একবার কারও নাম জানলে সেই নাম মনে রাখতেন এবং তাঁকে নাম ধরে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু যে আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে পরিণত হয়েছিলেন তাঁর প্রধান কারণ হলো তিনি যেকোনো কর্মীকে চিনতেন এবং তাঁর নাম ধরে ডাকতেন। জাতির পিতার এই বিরল গুণটি তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার মধ্যে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তৃণমূল পর্যন্ত প্রত্যেক নেতাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। তাদের নাম ধরে ডাকেন এবং তাদের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত থাকেন এবং তাদের সঙ্গে তিনি কথাবার্তা বলেন। একবার একজন কর্মীর সঙ্গে কথা বললে তিনি সেই কর্মীকে সারাজীবন মনে রাখেন।

(২) বিচক্ষণতা: জাতির পিতা প্রত্যেকটা কর্মীর দুর্বলতা এবং সবলতাগুলো জানতেন। কাকে দিয়ে কী কাজ করাতে হবে সেটা তিনি বিলক্ষণ বুঝতেন। সেই গুণটি পেয়েছেন তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাকে দিয়ে কী কাজ করানো যাবে সেটাও যেমন তিনি বোঝেন আবার বোঝেন কার কী দুর্বলতা।

(৩) সাহসিকতা: জাতির পিতা অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। তিনি জনগণের জন্য জীবন উৎসর্গ করতেন। জেল, জুলুম ইত্যাদি ভয় পেতেন না। সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন বলেই তিনি ছয় দফা প্রণয়ন করেছিলেন। ছয় দফার মাধ্যমে স্বাধীকার আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রূপ-পরিকল্পনা এঁকেছিলেন ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে। সাহসের দিক থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কম যান না। তাঁর অনেক সিদ্ধান্তই বাংলাদেশের জন্য সাহস ও প্রেরণা যোগায়। ২০০১ সালে নির্বাচনে বিপর্যয়ের পরও তিনি সাহস হারাননি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরও তিনি সাহস হারাননি। বারবার তাঁকে হত্যাচেষ্টার পরও তিনি ভয় পাননি। এই সাহসই তিনি পেয়েছেন জাতির পিতার কাছ থেকে।

(৪) আত্মমর্যাদা: জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অত্যন্ত আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদায় বিশ্বাসী। তিনি একাধিকবার বলেছেন, আমরা আত্মনির্ভর জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে চাই। যারা আত্মনির্ভর নয় তাঁদের কোনো সম্মান থাকে না। ভিক্ষার টাকা দিয়ে তারা চলতে পারে না। দেশকে তিনি স্বনির্ভর করতে চেয়েছিলেন। একই আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানবোধে বিশ্বাসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। তাঁর আত্মসম্মানবোধের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কালিমা লেপন করে যখন পদ্মাসেতু থেকে বিশ্বব্যাংক অর্থ প্রত্যাহার করে নিলো, তখন নিজেই তিনি নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করার ঘোষণা করলেন। আত্মসম্মানবোধের কারণেই তিনি যেকোনো রাষ্ট্রের কাছে করুণা ভিক্ষা বা অনূকম্পার চেয়ে তিনি স্বমর্যাদায় উদ্ভাসিত হতেই বিশ্বাসী।

(৫) শিশুবাৎসল্য: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন খুবই শিশুবৎসল, শিশুদের তিনি প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। একাধিক গ্রন্থে পাওয়া যায়, বঙ্গবন্ধু শিশুদের পেলে সবকিছু ভুলে যেতেন। তার এই গুণটা পেয়েছেন তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি খুব শিশুবান্ধব, শিশুদের পেলে তিনিও উচ্ছ্বসিত হয়ে যান। তিনি শিশুবান্ধব যতো নীতি এবং কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তা বিরল।

এটা তো গেলো মিলের বিষয়টি। কিন্তু পিতা ও কন্যার মধ্যে অমিলও কম না। রাষ্ট্রচিন্তা দর্শনের প্রায়োগিক বিষয়ে তাদের চিন্তাভাবনায় ভিন্নতা রয়েছে। কিছু কিছু বিষয়ে তা স্পষ্ট। এখন দেখা যাক তাদের অমিলগুলো কী কী-

(১) অনলবর্ষী বক্তৃতা: বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা। তিনি বক্তৃতা দিয়ে পুরো জাতিকে মুগ্ধ করতে পারতেন। তাকে বলা হতো, ‘দ্য পোয়েট অব পলিটিক্স’ অর্থাৎ রাজনীতির কবি। তার প্রত্যেকটা বক্তৃতা কালোত্তীর্ণ এবং একটা করে দর্শন। তিনি লিখিত বক্তব্য নয়, সবসময় উপস্থিত বক্তৃতা দিতেন। এই উপস্থিত বক্তৃতার মাধ্যমে নিজের দর্শন-চিন্তা ফুটিয়ে তুলে মানুষকে মোহাবিষ্ট করতেন তিনি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধিকাংশ সময়ই নোট নিয়ে বক্তৃতা দেন। জাতির পিতার বক্তৃতার সঙ্গে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতার কোনো মিল নেই। এই দুজনের বক্তৃতার মধ্যে তুলনা করাই এক ধরণের ধৃষ্টতা।

(২) নিরাপত্তা সচেতনতা: জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়ে খুবই উদাসীন ছিলেন এবং তিনি নিরাপত্তার বেড়াজালকে তিরস্কার করতেন। বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়, ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের আগে একাধিকবার বলা হয়েছিল যে তিনি যেন ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে বঙ্গভবন বা গণভবনে চলে যান। বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাহার করেছিলেন। কারণ তিনি নিরাপত্তার বাড়াবাড়িকে পছন্দই করতেন না। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপত্তার বিষয়টি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নিয়োজিত ব্যক্তিদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। নিরাপত্তার ঘেরাটোপ তিনি কঠোরভাবেই অনুসরণ করেন।

(৩) সহজে বিশ্বাস: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেকোনো মানুষকেই খুব সহজে বিশ্বাস করতেন। তিনি সবসময় বলতেন যে, এই বাংলাদেশ আমি প্রতিষ্ঠা করেছি। কাজেই বাঙালিরা কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। তার দলের নেতাকর্মীসহ সবাইকে তিনি অন্ধভাবে বিশ্বান করতেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আবার এই ক্ষেত্রে অনেক বাছবিচার রয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, তবে সেই বিশ্বাস নিঃশর্ত বিশ্বাস নয়, শর্তসাপেক্ষ বিশ্বাস। বিশ্বাস ভঙ্গ করলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না।

(৪) ক্ষমা: বঙ্গবন্ধুর যে ক্ষমা আর উদারতা ছিলো, সেই ক্ষমা আর উদারতার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকটাই কঠোর, তিনি কখনোই নিঃশর্ত বিশ্বাসে বিশ্বাসী নন। যার প্রমাণ পাওয়া যায় যে ওয়ান ইলেভেনের সময় দলের ভেতর যারা বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিল, অন্যচিন্তা করেছিল তাদের দলে দলে কোনঠাসা করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি।

(৫) প্রতিপক্ষের প্রতি উদারতা: জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ব্যাপারে উদার। দীর্ঘদিন জেল-জুলুমের শিকার হওয়ায় তিনি কখনই প্রতিপক্ষের ব্যাপারে কঠোর হতে পারেননি। অনেকেই মনে করেন এটা বঙ্গবন্ধুর অন্যতম দুর্বলতা। কথিত আছে, শেখ মুজিব দালাল আইনে ও যুদ্ধাপরাধ আইনে বিচারের সময় বেশ কয়েকজন স্বাধীনতাবিরোধীদের জেলে ঢুকিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাদের পরিবার পরিজন যেন অভাব অনটনে না থাকে, সেদিকেও খেয়াল রেখেছিলেন। শাহ আজিজুর রহমান খান, সবুর খানের পরিবার দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর আর্থিক আনুকূল্য পেয়েছিলো বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তার কন্যা শেখ হাসিনা সম্ভবত ৭৫’র ১৫ আগস্টের ঘটনার থেকে শিক্ষা নিয়ে সাবধান হয়ে যান। তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি এমন উদারতায় বিশ্বাসী নন।

যেকোনো বিচারেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি বাঙালির মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা। তার সঙ্গে কারোরই তুলনা চলে না। কিন্তু যেহেতু তার কন্যার যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ তার দেখানো পথেই হেঁটে চলেছে, একারণে আজ জাতির পিতার জন্মদিনে এই দু’জনের তুলনাটা হয়তো প্রাসঙ্গিক।

— বাংলা ইনসাইডার

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর