হাতুড়ি হাতে ইউটিউবে ঝড় তুলেছেন যে তরুণী

তার বয়স মাত্র ২৫। আর এই বয়সেই ইউটিউবে রীতিমত ঝড় তুলেছেন এই তরুণী। মেয়েরা সাধারণতঃ ইউটিউবে রান্নবান্না, ফ্যাশন বা সৌন্দর্য বিষয়ক চ্যানেল নিয়েই কাজ করে থাকেন। কিন্তু কোনো চেনা পথে হঁটেননি এই তরুণী। তিনি ইউটিউব মাত করেছেন নির্মাণ বিষয়ক পরামর্শ দিয়ে, যা এতদিন ধরে পুরুষের রাজত্ব বলেই বিবেচিত হয়ে আসছিলো।

এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম তার নাম পালোমা সান্তোস। দক্ষিণ-পূর্ব ব্রাজিলের সেতে লাগোয়াস শহরের বাসিন্দা। এই শহরের লোকসংখ্যা মাত্র দুই লাখ সাঁইত্রিশ হাজার। কিন্তু এখন তার ইউটিউব চ্যানেল ‘পালোমা সিপ্রিয়ানো’র মোট সাবস্ক্রাইবার ছয় লাখ ২৫ হাজার। মানে তার শহরের লোকজনের তুলনায় তিন গুণ বেশি তার ইউটিউব চ্যানেলের অনুসারী।

ইউটিউবে ২৫ বছর বয়সী এই তরুণীর আলোচনার বিষয় বিভিন্ন ধরণের নির্মাণ কাজ। তিনি ব্রাজিলের একমাত্র নারী সদস্য যিনি নির্মাণ বিষয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন।

মূলত মা আইভনির পরামর্শেই পালোমা ইউটিউব চ্যানেলের জন্য এমন একটি ভিন্ন বিষয়বস্তুকে বেছে নেন।

একদিন মা তাকে মেঝের টাইলস বসানোর একটি ভিডিও আপলোড করার পরামর্শ দেন। আইডিয়াটা মোটেও পছন্দ হয়নি পালোমার। তারপরও তিনি সেটা পোস্ট করেছিলাম। এভাবেই যাত্রা শুরু তার পালোমা সিপ্রিয়ানো চ্যানেলের। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও এখন পর্যন্ত ৭৫ লাখ বার দেখা হয়েছে। ওই ভিডিও টিউটোরিয়ালে তিনি কীভাবে একটি দেয়ালে প্লাস্টার করতে হয় সেটি দেখিয়েছিলেন ।

নির্মাণ শিল্প কেন্দ্রিক ইউটিউব চ্যানেলের হিসেবে ব্রাজিলের অন্য যেকোনো চ্যানেলের তুলনায় পালোমা অনেক বেশি অনুসারী অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। তার ইনস্টাগ্রামেও ফলোয়ারের সংখ্যা ৪৫ হাজারেও বেশি।

নিজের প্রিয় যন্ত্রপাতির সঙ্গে পালামো

তার চ্যানেলে অন্যান্য ভিডিওগুলোয় ধাপে ধাপে ডিআইওয়াই (ডু ইট ইওরসেল্ফ) অর্থাৎ যেকোনো কাজ নিজে করার মতো উপায় দেখানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে মেঝেতে টাইলস বসানো, পানির কল ফিট করা এমনকি, কি করে একটি দেয়াল তুলতে হয় সেটাও। পালোমার এই ভিডিওগুলো বেশ সোজাসাপ্টা আর সহজ নির্দেশাবলী সম্পন্ন।

‘আমি মানুষকে এমন জিনিসই দেখাই যেটা তারা করতে পারবে। আমি মনে করি যেটা আমি করতে পারি অন্যরা সেটা সবাই পারবে।’

কথায় বলে প্রয়োজন বড় বালাই। আর এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই বিভিন্ন নির্মাণ কাজ শিখতে শুরু করেন পালামো। পালোমা ও তার মা আইভোনেকে নিজেদের দুই রুমের বাড়িটি বর্ধিত করার প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু শ্রমিকদের দিয়ে করানোর মতো অর্থ তাদের কাছে ছিলনা। তাই সেটা নিজেদেরকেই করতে হয়েছিলো। এভাবেই আস্তে আস্তে নির্মাণ কাজ শিখে যান পালামো। শুধু শেখা নয়, দ্রুত এই কাজের প্রেমে পড়ে যান।

নিজের ঘর নিজেই বানিয়েছেন পালামো

এই নির্মাণ শিল্প নিয়ে পড়াশোনার জন্য ২০১৩ সালে স্থানীয় এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু ততদিনে নিজের ইউটিউব চ্যানেল ‘পালোমা সিপ্রিয়ানো’শুরু হয়ে গেছে। এখানে নিজের সমস্ত সময় উৎসর্গ করার জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াটা আর শেষ হলো না পালামোর। প্রথম সেমিস্টারেই ঝরে পড়েন।

পালোমা তার নিজের বাড়ির উন্নয়নের কাজ নিজে করার ফলে প্রায় ৭০০০ ডলার সাশ্রয় করতে পেরেছেন। এনিয়ে পালঅমোর স্বীকারোক্তি, ‘আমি যা করেছি তা অন্য কাউকে দিয়ে করার মতো সামর্থ্য আমার ছিল না।’

পুরুষদের রাজত্বে এক নারী

ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) -এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ব্রাজিলের নির্মাণ কাজে নিয়োজিত কর্মীদের মধ্যে কেবলমাত্র ৩.২% নারী। তাই পুরুষ আধিপত্যের এই সেক্টরে পালোমার বিরল সফলতায় প্রধান অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন তার মা আইভোনে।

এই পুঁচকে মেয়েটা এসব বানিয়েছে? অনেকে তো বিশ্বাসই করতে চায় না

‘আমার মা সব ধরনের কাজ করেছেন। যখন আমরা ছোট ছিলাম তখন তিনি ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে জমি থেকে আগাছা পরিষ্কারের কাজ করতেন। তার ইচ্ছাশক্তি আমাকে শক্তি দেয়।’

তবে পালোমার ভাইবোনেরা ভিন্ন ভিন্ন দিকে কাজ করেছেন। তার দুই বোন ভবনের কাজ থেকে দূরেই ছিলেন। কিন্তু তার ১৩ বছর বয়সী ছোট ভাই, তার ভিডিওগুলি তৈরি করতে সহায়তা করে।

অনেক চ্যানেল অনুসারীরা পালোমার এমন খ্যাতি অর্জনে আনন্দ প্রকাশ করেছেন।

তবে শুরুটা অত মসৃণ ছিল না। তখন তার করা ভিডিও দেখে মানুষ মনে করতো কোনো পুরুষ কর্মীর সাহায্য নিয়েই তিনি এটা করেছেন। এ নিয়ে প্রথম দিকে খুব দুঃখ পেতেন পালোমা। কিন্তু এখন এসব কাটিয়ে উঠতে পরেছেন। যে কারণে কোনো সমালোচনাই তাকে আর বিব্রত করতে পারে না। পালোমা এখন তার ভিডিও থেকে বিরূপ মন্তব্যগুলো হয় এড়িয়ে যান, না হলে মুছে ফেলেন।

পালোমার অনুসারীদের মধ্যে ৬০ শতাংশই পুরুষ। কিন্তু দিন দিন তার চ্যানেলে নারী অনুসারীর সংখ্যা বাড়ছে বলেও তিনি জানান। আর তার চ্যানেলের এসব নারী অনুসারীরাই তাকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ যোগান।

হে নারী, নিজের কাজ নিজেই করুন

পালোমার ব্যবসা বাড়ানোর একটি কৌশল আছে: তিনি আরও বেশি নারীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে তাদের নিজে নিজে কাজ করার তাগিদ দেন, যেটা ইংরেজিতে ডু ইট ইউরসেল্ফ বা সংক্ষেপে ডিআইওয়াই নামেই বেশি পরিচিত।

এ নিয়ে পালামার প্রশ্ন,‘যদি আমি প্রকৌশলবিদ্যার কোন ডিগ্রি ছাড়াই একটি কংক্রিট স্তম্ভ তৈরি করতে পারি, তাহলে তারা (নরীরা) কেন বৈদ্যুতিক ঝরনা বসাতে পারবে না?’

এই নির্মাতা বিশ্বাস করেন নারীরা চাইলে একা একাই সব করতে পারবে, এমনকি ব্যবসাও শিখতে পারবেন।

তাই পালামা বলেন, ‘পুরুষরা যতোটা ভাবে যে তাদেরকে আমাদের অনেক দরকার, আমাদের এটা দেখাতে হবে যে, আমাদের এগিয়ে যেতে তাদের কোন প্রয়োজন নেই।’

পেশাজীবী ইউটিউবার

পালোমার ইউটিউব চ্যানেলে ১৫০টির বেশি ভিডিও রয়েছে এবং তিনি বলতে গেলে একজন পেশাদার ইউটিউবর হয়ে উঠেছেন।

তিনি নিজেই এসব ভিডিও ধারণ করেন, সম্পাদনা করেন এবং প্রযোজনা করেন। অথচ আগে তিনি টাইপিস্ট সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন। অনেক সময় রাস্তায় রাস্তায় লিফলেট বিলি করেও তাকে উপার্জন করতে হয়েছিল।

পালোমার প্রতিটি ভিডিও ধারণ করা হয়েছে শুধুমাত্র একটি ক্যামেরা দিয়ে এবং তার এই কাজ শেষ করতে গড়ে এক থেকে তিন দিন সময় লাগতো।

প্রতিটা ভিডিওর বিষয়বস্তু বা থিম বের করার ক্ষেত্রে পালোমা চিন্তা করতেন তার বাড়িতে নিজের প্রয়োজনে কোন কাজগুলো করতে হয়। সেই প্রয়োজনীয়তা অনুসন্ধান করেই তিনি ভিডিও নির্মাণের বিষয় নির্বাচন করতেন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে যা যা করার দরকার হয়, আমি তাই করি। আমি বাড়ির দেয়াল রং করেছি, বইয়ের/কাপড়ের তাক বানিয়েছি। এমনকি সুইমিংপুল বানানোও বাদ যায়নি।’

যে নারী এক সময় ভ্রমণ নিয়ে ব্লগিং করার স্বপ্ন দেখতেন, এখন তিনি তার চ্যানেলের সুবাদে অনেক জায়গাতেই ঘুরে বেড়ান। তবে তার উদ্দেশ্য বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নিয়ে মানুষকে শেখানো আর উদ্বুদ্ধ করা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার এই চলাচলের খরচ বহন করে থাকে ডিআইওয়াই দোকানগুলো।

স্পন্সরের থেকে পাওয়া এই টাকা তাকে একটি ডিগ্রি নিতে, সেইসঙ্গে আত্মীয়-স্বজনদের প্রয়োজনেও কাজে আসছে।

‘আমি জানি যে আমার জীবনের অভিজ্ঞতা অন্যান্য নারীদের মতো নয়, কিন্তু আমি মনে করি মানুষ যা চায় সেটা নিয়ে সন্দেহ করার পরিবর্তে আর খুব বেশি চিন্তা না করে সেটা অর্জনে লেগে পড়া উচিত। যখন তা হয়ে যাবে তখেই আপনি মূল্যায়ন করবেন এবং এটা থেকেই শিখবেন।’

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর