‘আমরা নামাজ পড়ার চেষ্টা করেছিলাম, শেষ নামাজ’

ভাইরাল হওয়ার জন্য নয় বরং মায়ের আশা পূরণের জন্যই ফেসবুকে ছবি দিয়েছিলেন বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের সময় আটকা পড়া হাছনাইন আহমেদ রিপন। তিনি বলেন, ওই সময় মা আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন। তাই ছবিটি পোস্ট করেছিলাম।

সোমবার সে দিনের ঘটনায় নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ভোলার এ যুবক।

তিনি জানান, ঘটনার প্রথম দিকেই যারা বুঝতে পেরেছিলেন, তারা আগেই বের হয়ে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু যারা, দু’য়েক মিনিট দেরি করেছেন তারাই আটকা পড়েছেন।

রিপন বলেন, আমরা দুই এক মিনিটের মধ্যেই রিসিপশনে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রচণ্ড ধোঁয়ার কারণে বের হতে পারছিলাম না। এরপর আমরা দ্রুত বাথরুমে গিয়ে তোয়ালে ভিজিয়ে নাক-মুখে পেঁচিয়ে বের হবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনো ভাবেই সেটা সম্ভব হলো না। আমরা ভেতরে সবাই মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে কয়েকবার ইমার্জেন্সি গেট পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। এরপর আমরা ভেতরেই অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেই।

ঘটনার সময় প্রথম দিকে ভেতরে খুব বেশি ধোঁয়া প্রবেশ না করলেও বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে সব জায়গায় ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে জানিয়ে রিপন বলেন, ‘আমরা তখন গ্লাস ভাঙতে শুরু করলাম। ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো চলে এসেছিল। আমরা সেটা দেখছিলাম।’

‘আমরা শুধু ধোঁয়া পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না, আগুন কোন ফ্লোরে। নিচ থেকে অনেকেই বলছিল আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে, তোমরা ধৈর্য ধরো। কিন্তু যখন গ্লাসগুলো গরম হয়ে যাচ্ছিল তখন আমরা বুঝতে পারি ঘটনা খুবই কঠিন।’

‘যখন শুনলাম, আগুন অন্য ফ্লোরে চলে গেছে তখন আমরা একেবারেই আশা ছেড়ে দেই।’

রিপন জানান, ওই ফ্লোরে পঞ্চাশ থেকে ষাট জন লোক থাকলেও প্রথম দিকেই অনেকে বের হয়ে যান। বাকি পনেরো থেকে ষোলো জন লোক আটকা পড়েন।

তিনি বলেন, ‘আমরা যারা আওয়াজটা ঠিকমতো পাইনি তারাই আটকা পড়েছিলাম। আমরা নামাজ পড়ার চেষ্টা করছিলাম, শেষ নামাজ। কিন্তু ওজু করতে পারছিলাম না। সবাই আল্লাহর নাম নিচ্ছিলাম।’

ধোঁয়ার সঙ্গে লড়াই করে বিকাল ৪টা নাগাদ অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। কেউ কেউ ফ্লোরে শুয়ে পড়েন।

রিপন বলেন, ‘সোয়া ৪টার দিকে ক্রেন আসে। আমাদের মধ্যে যারা বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছিল আগে তাদের নামিয়ে দিয়ে আমরা পাঁচজন সবার পরে নামি।’

তিনি বলেন, ওই সময় আমাদের এমপি সাহেব (ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য) আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব আমাকে ছাদে উঠে যেতে বলেছিলেন। তিনি স্পেশাল হেলিকপ্টার পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা কোনো ভাবেই ছাদে যেতে পারছিলাম না। খবর পেয়ে আমার মা অজ্ঞান হয়ে যান। তখন ভোলা থেকে এমপি সাহেব আমার ছোট বোন এবং তার স্বামীকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে আসেন।

রিপন বলেন, বাঁচবো, ‘এই আশা আসলেই ছিল না।’ কথা বলার এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন ভোলার চরফ্যাশনের এ যুবক। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমি শেষ বারের মতো পৃথিবীকে দেখছি। আমরা সবাই সবার কাছ থেকে শেষ বারের মতো বিদায় নিয়ে নিচ্ছিলাম।’

ফেসবুকে ছবি পোস্ট করার প্রসঙ্গে রিপন বলেন, ‘আমার মা আমাকে ওই মুহূর্তে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি কল (ভিডিও) দিতে পারছিলাম না। কারণ, ধোঁয়ায় ভর্তি হয়ে গেছে। তখন আমি মোবাইলে ছবি তুলে পোস্ট করেছিলাম। আমি ভাইরাল হওয়ার জন্য এটা দেইনি। আমার মা আমাকে লাস্ট মুহূর্তে দেখতে চেয়েছিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে মৃত্যুর শেষ দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি।’

‘নিচে লোকজন দেখছিলাম। আত্মীয়-স্বনদের দেখছিলাম। বন্ধু-বান্ধব, স্বজনরা অনেকে ফোন দিচ্ছিল। কিন্তু বাঁচবো যে সেটা কখনো ভাবিনি।’

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে আগুন লাগার পর ১৪ তলার ওপরে থেকে রিপন ফেসবুকে সবাইকে বিদায় জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে ফেসবুকে লেখেন, ‘মা, মিলন, মিনা আপু ফাহিম ভাই সবাই আমারে মাফ করে দিস।’

হাছনাইন আহমেদ রিপন ভোলার চরফ্যাশন পৌরসভার ৬নং ওয়াডের নুরনবী মাস্টারের ছোট ছেলে।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর