ব্রুসেলোসিস রোগের ইতিবৃত্ত

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে প্রাণীসম্পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিভিন্ন রোগের কারণে দেশের প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেওয়ায় প্রানীজ আমিষের দাম বেড়েই চলেছে। প্রাণীজ আমিষের দাম দিন দিন মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে পশুসম্পদ শিল্পে প্রতি বছর গবাদি পশুর একটি জুনোটিক রোগ ব্রুসেলোসিস কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি সাধন করছে। ব্যাকটিরিয়া জনিত এ রোগটি প্রাণীর দেহ থেকে মানুষের দেহে সংক্রামিত হয়। রোগটি ব্রুসেলা গনের গ্রাম নেভেটিভ ব্যাকটিরিয়া দ্বারা হয়ে থাকে। গৃহপালিত প্রাণী যেমন গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল, শুুকর এবং কুকুর এর রোগের পোষক। পাঁচটি প্রজাতির ব্যাকটিরিয়ার দ্বারা গৃহপালিত পৃাণীতে ব্রুসেলোসিস হয়ে থাকে। ব্রুসেলা এবর্টাস গরু ও মহিষে, ব্রুসেলা ওভিস ছাগলে ও ভেড়ায়, ব্রুসেলা কানিস ভেড়ায় এবং কুকুরে ব্রুসেলোসিস রোগের জন্য দায়ী। এই রোগটি মধ্যপ্রাচ্য, ভূ-মধ্যসাগরীয়, এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা দেশ সমূহে বিদ্যমান আছে কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশেও এটি মারাত্মক ক্ষতি সাধন করছে।

ব্রুসেলোসিস ব্যাকটেরিয়া ঘটিত একটি সংক্রামক রোগ হওয়ায় এ রোগটি খাদ্য, আক্রান্ত পশুর মাধ্যমে ছড়াতে পারে। পশুর কাঁচা দুধ, স্বল্প জাল দেয়া দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে অথবা নির্গত পদার্থের বা আক্রান্ত প্রাণীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংস্পর্শে মানুষের এ রোগ হতে পারে। গর্ভপাত এবং মৃত বাচ্চা প্রসবকারী প্রাণীর পরিচর্যাকারী খামারী এবং চিকিৎসা প্রদানকালে প্রাণী চিকিৎসক এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। ব্রুসেলোসিস রোগ গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও শূকরের গর্ভাবস্থার শেষের দিকে গর্ভপাত ঘটায়। গর্ভপাত, দুগ্ধ উৎপাদন হ্রাস, বাচ্চার মৃত্যু, প্রজননে ব্যাঘাত, গর্ভফুল আটকে যাওয়া, জরায়ু প্রদাহের জন্য রোগটি দায়ী। ফলে দুগ্ধখামার ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি সম্মুখীন হয়। আমাদের দেশে গ্রামা লে মহিলারা গবাদি পশুর লালনপালন করে থাকেন। ফলে গর্ভবতী মহিলা এ রোগে আক্রান্ত হলে গর্ভপাত হতে পারে।

গবাদি পশুতে এ রোগ সনাক্ত করণের জন্য অনেক পরীক্ষা রয়েছে। প্রাণীর রক্ত বা দুধে এই রোগের এন্টিবডির উপস্থিতি নির্ণয়ের মাধ্যমে ব্রুসেলোসিস রোগ সনাক্ত করা হয়। তবে এই পরীক্ষা গুলো অনেক সময় আক্রান্ত প্রাণীতে সঠিকভাবে ব্রুসেলোসিস রোগ নির্ণয় করতে পারে না। তাই কোন প্রাণীতে ব্রুসেলোসিস নিশ্চিত করার সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হলো আক্রান্ত প্র্ণী থেকে এ রোগের ব্যাকটিরিয়া পৃথক করা এবং কোন ব্যাকটেরিয়া তা সনাক্ত করা।

বাংলাদেশের গবাদি পশু এবং মানুষের দেহে এ রোগটি এন্টিবডির উপস্থিতি নির্ণয় করা গেলেও কোন প্রজাতির দ্বারা এই রোগটি হয় তা দীর্ঘদিন যাবৎ অজানা ছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ আরিফুল ইসলাম এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত গবেষনায় রোগের ব্যাকটিরিয়া সফল ভাবে পৃথকীকরণ এবং সনাক্তকরণ সম্পন্ন হয়েছে। এ ব্যাকটিরিয়ার পূর্ণ জীবন বৃত্তান্ত উন্মোচন করা হয়েছে এবং জিন ব্যাংকে জমা করা হয়েছে। এই গবেষনাটির ফলাফল বাংলাদেশে গবাদি পশুতে ব্রুসেলোসিস রোগ নির্ণয় পদ্ধতি এবং এর কার্যকর টিকা উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বাংলাদেশ থেকে ব্রুসেলোসিস নিধনে এটি সম্ভাবনার একটি নতুন দ্বার উন্মোচিত করবে।

বাংলাদেশে গবাদি পশুতে ব্রুসেলোসিস রোগ নিয়ন্ত্রনে এখনই কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন করা অত্যন্ত জরুরী। কারণ আক্রান্ত প্রাণী এ রোগের বাহক হিসাবে কাজ করে এবং এর থেকে অন্যান্য প্রাণীতে রোগটি ছড়ায়। প্রাণীতে এই রোগ নিয়ন্ত্রন করা গেলে মানুষেও এই রোগের প্রভাব কমানো সম্ভব। ব্রুসেলোসিস আক্রান্ত প্রাণীতে গর্ভপাত হয়ে থাকে। তাই কোন খামারের গাভীতে গর্ভপাত হলে সেটি অবশ্যই খামারীকে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রাণী সম্পদ অফিসে জানাতে হবে। গর্ভপাতের কারণ অনুসন্ধানের জন্য প্রাণী সম্পদ বিভাগকে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রাণী সম্পদ বিভাগে ব্রুসেলোসিস রোগ সনাক্ত করণের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগার সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। গর্ভপাত হলে কিভাবে মৃত বাচ্চা সৎকার করতে হবে সে ব্যাপারে খামারীদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। খামারে স্বাস্থ্যবিধি এবং স্যানিটারি পদ্ধতি সর্ম্পকে খামারীদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান করতে হবে। খামারে কিভাবে জীবানুনাশক প্রয়োগ করতে হবে এবং জীবানু হতে কিভাবে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে সে ব্যাপারে খামারীকে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। গবাদি পশুতে ব্রুসেলোসিস রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কার্যকরী উপায় হলো টিকা প্রদান। রোগের প্রার্দুভাব কমানোর জন্য টিকা প্রদান কর্মসূচী গ্রহণ না করলে সেক্ষেত্রে পরীক্ষা করে আক্রান্ত পশুকে মেরে ফেলে এই রোগ নিয়ন্ত্রন করার পদ্ধতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চালু আছে।

গবাদি পশুতে এ রোগ নিয়ন্ত্রন করলে মানুষেও এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। খামারে এ রোগে আক্রান্ত পশুকে দ্রুত সনাক্ত করে সেটি সঠিক ভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত জৈব নিরাপত্তা হাইজিন ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে গবাদিপশুতে এ রোগ নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। টিকা প্রদানের মাধমে এ রোগ নিয়ন্ত্রন করা অপেক্ষাকৃত কম ব্যয় বহুল হলেও বাংলাদেশের গবাদি পশুতে এ রোগের বিরুদ্ধে টিকা প্রদান করা হয় না। বাংলাদেশের গবাদি পশুতে বিদ্যমান ব্যাকটিরিয়া হতে টিকা উন্নয়ন করে তার কার্যকারীতা ও নিরাপত্তা ল্যাবরেটরি এ্যানিমেলে নিশ্চিত করে ফিল্ড ট্রায়াল দিয়ে এর কার্যকারিতা প্রমাণ সাপেক্ষে সেটি গবাদি পশুতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ব্রুসেলোসিস রোগের টিকা বা ভ্যাক্সিন নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) অধ্যাপক ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান জানান, ‘ব্রুসেলা অ্যাবোরটাস’ ব্যাকটেরিয়ার প্রায় ৯ টি অ্যান্টিজেন বিশিষ্ট ভ্যারাইটি পাওয়া গিয়েছে যাদের বায়োভার বলা হয়। বিভিন্ন সময় গবেষণা করে দেশে গরুর ব্রুসেলসিস রোগের জন্য দায়ি ‘ব্রুসেলা অ্যাবোরটাস বায়োভার-৩’ ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করা হয়েছে। ব্রুসেলসিস রোগ প্রতিরোধের জন্য উন্নত দেশ সমূহে ১৯ এবং আর বি ৫১ নামক দুটি টিকা বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন টিকা কাজ করে না এবং এ টিকার কারণে অনেক সময় গর্ভবতী প্রাণিতে গর্ভপাতও হতে পারে। তাই আমরা দেশীয় জিবানুর স্ট্রেইন দ্বারা ঘটিত ব্রুসেলসিস রোগে প্রতিরোধের জন্য বাংলাদেশে ব্রুসেলা বায়েভার-৩ সনাক্ত করে হিট কিলড্ ভ্যক্সিন তৈরী কারেছি। বাংলাদেশে এটিই বরুসেলা রোগ প্রতিরোধের জন্য টীকা তৈরির প্রথম পদক্ষেপ। এই গবেষণার জন্য , গর্ভপাত ঘটেছে এমন গাভী থেকে মৃত বাচ্চা ও গর্ভফুল নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সেইসকল নমুনা থেকে নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন কালচার এর মাধ্যমে জীবাণু আলাদা করা হয়, পরে সেই জীবাণুকে নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে অকার্যকর করা হয়, যেন তা প্রানিদেহে রোগের সৃষ্টি করতে না পারে। তারপর তৈরিকৃত সেই অকার্যকর জীবাণু টীকা হিসেবে এর কার্যকারিতা অবলোকন করার জন্য গিনিপিগ এর শরীরে প্রবেশ করানো হয়। প্রতিসপ্তাহ অন্তরে ৯ সপ্তাহ পর্যন্ত ফলাফল রেকর্ড করা হয় এবং দেখা যায় যে, ২য় সপ্তাহ থেকে এই টীকা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা শুরু করে, চতুর্থ সপ্তাহে সর্বোচ্চ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে, তারপর আবার প্রতিরােধ ক্ষমতা কমতে শুরু করে, এবং নবম সপ্তাহে এই টীকার কোন প্রতিরােধ ক্ষমতা পাওয়া যায় নি। এই টীকাকে আরও কার্যকরী এবং মানসম্মত তৈরি করার জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছি। এই টীকা প্রাণিদেহে যদি আশারুরূপ রোগ প্রতিরােধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম হয়, তাহলে এটি আমাদের প্রানিসম্পদ রক্ষার্থে এক বিশাল আশীর্বাদ হিসেবে গৃহীত হবে। গাভীর গর্ভপাত ও বাছুরের অকাল মৃত্যুরােধ এবং মানুষের সংক্রমণের রুখে দাঁড়াতে সম্ভাবনার দ্বার উন্মােচিত হবে এবং বাংলাদেশের পশুপালন নির্ভর অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে ।

বার্তাবাজার/ডব্লিওএস

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর