দখল দূষণে মৃতপ্রায় সাভারের খাল-বিল ও জলাশয়গুলো

প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলদারিত্বে মৃতপ্রায় সাভার ও আশুলিয়ার বিখ্যাত খালগুলো। এক সময়ের স্রোতস্বিনী খালগুলো তাদের প্রবাহ হারিয়ে পরিণত হয়েছে সরু নালায়।

২৮২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে সাভার উপজেলা বংশী, ধলেশ্বরী আর তুরাগ নদী দ্বারা বেষ্টিত। এই ছোট্ট এলাকার টোপোগ্রাফি (Topography) বলে দেয় রাজধানীর প্রবেশ মুখ সাভার নামের এই জনপদ কতটা সমৃদ্ধ ছিলো। তিন দিকেই প্রবাহিত নদীগুলোর সাথে অসংখ্য খাল, বিল, সমতল জমির পাশাপাশি বন্যামুক্ত এলাকাও কম নয়।এক সময়ে খাদ্যে উদ্বৃত্ত, ব্যবসা বাণিজ্যে প্রসিদ্ধ সাভার এখন অপরিকল্পিত ভাবে শিল্পায়ন, নগরায়ন এবং অবৈধ দখলদারিত্বে প্রায় বসবাসের অযোগ্য একটি জনপদে পরিণত হয়েছে।

মূলত দুইভাবে সাভার ও আশুলিয়ার খালগুলো মরে যাচ্ছে। প্রথমত অবৈধ দখলদারদের জন্য এবং দ্বিতীয়ত কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি খালে ফেলে দেয়ায়। সাভার উপজেলায় তিনটি অঞ্চল এই দখল এবং দূষণ উভয়ই খুবই প্রকট আকার ধারণ করে আছে। এগুলি হলো- দক্ষিণ পাথালিয়া-উত্তর সাভার নিম্ন অঞ্চল, কর্ণপাড়া খাল-বিল বাঘিল সংলগ্ন নিচু অঞ্চল এবং ইপিজেড- ধলাই বিল অঞ্চল।

পাথালিয়া ইউনিয়নের নয়ারহাট এলাকা থেকে শুরু করে দক্ষিণে সাভারের উত্তর পর্যন্ত উত্তর দক্ষিণে লম্বা লম্বি প্রায় ১৫ কিলোমিটার জুড়ে কয়েক হাজার হেক্টর জমি ঘিরে প্রবাহমান খাল/বিল গুলোর পানি দূষিত এবং ব্যবহারের অযোগ্য। নয়ারহাট বাজারের পাশে বিশ্বাস গ্রুপ, এইচআরসি (HRC), গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, কোহিনুর টেক্সটাইল সহ অসংখ্য শিল্প কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য অবৈধ দখলদারীর পরেও খাল-বিল গুলোর যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সেখানে পতিত হয়ে ভয়াবহ দূষণের সৃষ্টি করছে। এসব খাল ও বিলের মধ্যে রয়েছে- পাকুরিয়া বিল, তাতী বিল, শুকনা বিল, রইপতা বিল, নোয়াদ্দা খাল, রক্তারপুর খাল ইত্যাদি। এই অঞ্চলের সাথে সংযুক্তকারী উৎসমুখ এবং নয়ারহাট বাজারের উজানে বিখ্যাত যোগী-জাঙ্গাল (জুগী জঙ্গল) খাল বন্ধ করে রাতারাতি বড় ইন্ডাস্ট্রি নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই। সভ্যখালি নামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাল বন্ধ করে ইতোমধ্যে তৈরী হয়েছে বাড়ী ঘর। মোটকথা যোগী-জাঙ্গাল ও সভ্যখালি খাল বন্ধ করায় এই অঞ্চল্টা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে।

সম্প্রতি নয়ারহাট এলাকায় প্রবাহমান যোগী-জাঙ্গাল ও পাকুরিয়া বিলে বালু ফেলে বিভিন্ন আবাসন প্রতিষ্ঠান ভরাট করে ফেলেছে। ফলে সেখানে পানির স্বাভাবিক প্রবাহের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বন্যাসহ স্থায়ী জলবদ্ধতার কবলে পড়ছে ওই এলাকার মানুষ।

এব্যাপারে নয়ারহাট ভূমি অফিসে গিয়ে এই যোগী-জাঙ্গাল খালের নক্সায় বর্তমানে এর অবস্থানসহ এসংক্রান্ত অন্যান্য তথ্যাদি জানতে চাইলে ভূমি অফিসের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা কিছুই জানেন না এবং খালের যে অংশ দখল করা হয়েছে সেগুলি ব্যক্তিগত জমি উল্লেখ করে তথ্য প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে তিনি এই বিষয়ে সাভার উপজেলা ভূমি অফিসে গিয়ে সংশ্লিষ্ট সার্ভেয়ারের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ প্রদান করেন। সেই অনুযায়ী সাভার উপজেলা ভূমি অফিসে গিয়ে সংশ্লিষ্ট সার্ভেয়ারের নিকট ম্যাপে খালটির বর্তমান অবস্থান সহ তথ্য জানতে চাইলে সার্ভেয়ার জানান যে এই নামে কোনো খাল রয়েছে কিনা এটাই তার জানা নেই!! এমনটি শুনে অবাক হবার কিছু নেই। যে হারে সাভার/আশুলিয়ার নদী/খাল/বিল দখলের মহা উৎসব শুরু হয়েছে এবং ভূমি অফিসের কতিপয় অসাধু দায়িত্বরতদের যোগসাজশে সেগুলি ব্যক্তির নামে রেকর্ড করিয়ে নেয়া হচ্ছে, তাতে এমন একদিন আসবে যে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানবে সাভার উপজেলায় কখনোই কোনো নদী/খাল/বিল এর কোনো অস্তিত্বই ছিলো না।

আবার, ধলেশ্বরী নদীর বাম দিকের পাড় কর্ণপাড়া খালের উৎসমুখ। প্রাচীন এই খালটির বিভিন্ন অংশের পাড় প্রভাবশালীরা দখল করে নেয়ায় এটাও প্রায় মরে গেছে। এদিকে বিখ্যাত বিল বাঘিলের বিল আর নেই। বর্তমানে সেটা খাল হয়ে জর্ণপাড়া খালের সাথে মিলিত হয়ে তুরাগ নদীর সাথে মিলেছে। ভূমি দস্যুরা বিল বাখিলের বেশীরভাগই নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। কর্ণপাড়া খালের বাম পাশে উলাইল এলাকা অঘোষিত শিল্পাঞ্চল ঘোষিত হওয়ায় এটা বর্তমানে এক ভয়ংকর এলাকা হিসেবে পরিগনিত হচ্ছে। এই শিল্প এলাকার সকল বর্জ্যই কর্ণপাড়া খালে পড়ছে বিনা বাধায় অথচ দেখার কেউ নেই। আবার, কর্ণপাড়া খালের মাঝখানে একটি দ্বিতল ভবন নির্মিত হয়ে প্রশাসনের নাকের ডগায় বহাল তবিয়তে থেকে ব্যঙ্গ করে চলেছে। এই খালের উভয় পাশের দখলদাররা প্রতিযোগিতা নিয়ে দখলের অনুশীলনে ব্যস্ত রয়েছে এমনটাই দেখা যাবে খাল ধরে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেলেই।

এদিকে, ইপিজেড-ধলাই বিল অঞ্চলের হাজার হাজার হেক্টর জমি গত ২০ বছর যাবত ফসলহীন হয়ে আছে এবং বিশেষজ্ঞদের অভিমত যে হারে ইপিজেড এর সকল বর্জ্য ধলাই বিল হয়ে বংশী নদীতে মিশে নয়ারহাটের উজান থেকে সাভারের ভাটিতে কর্ণতলী খাল পর্যন্ত নদীর পানি দূষিত করছে, তাতে আগামী ২০-২৫ বছরও এই অঞ্চলের জমিতে ফসল না হবার উপক্রম হয়েছে। এছাড়া এই দূষণের মাত্রা এত তীব্র যে এই এলাকার অনেক মানুষ তাদের আবাসস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে অথবা সীমাহীন কষ্ট স্বীকার করে দুর্গন্ধময় ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।

এদিকে, সাভারের আশুলিয়ার ৫ শতাধিক শিল্প ও কারখানার বর্জ্য এবং আবাসিক এলাকার বর্জ্যে নয়নজুলি খালটি এখন ছোট নর্দমায় পরিণত হয়েছে। একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক অবৈধভাবে এ খালটির দুই পাশ ভরাট করে তাদের শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছে। ফলে একসময়ের ৪০ ফুট প্রশস্ত খালটি এখন মাত্র ৪ ফুটের এক নর্দমায় পরিণত হয়েছে!

সরেজমিন দেখা গেছে, ইয়ারপুর ইউনিয়নের জিরাবো পুকুরপাড়া এলাকার লুসাকা গ্রুপ খালের মধ্যে সরু পাইপ দিয়ে তার উপর দিয়ে স্থাপনা তৈরি করেছে। এছাড়া শ্রীখন্ডিয়া গ্রামের আমান স্পিনিং মিল নামক কারখানার কিছু অংশ এই খাল ভরাট করে নির্মান করেছে। ফলে খালের পানি প্রবাহ থেমে গেছে এবং এই কারনেই এখানে সারাবছরই সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতার।

এছাড়া সরকারী নয়ন জুলি খাল দখল ও বন্ধ করে ঔ জমির উপর অনুমতিবিহীন ভাবে আবাসিক এলাকায় কারখানা তৈরি হওয়ায় দূর্ভোগে পড়ছে ওখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা।

এব্যাপারে পরিবেশ বাদী সংগঠন ‘সাভার ও ধামরাইয়ের নদী ও পরিবেশ আন্দোলনের’ সভাপতি ড. আতাউর রহমান জানান, সাভারের অনেক শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য নদী/খাল/বিলে ফেলা বন্ধ তো হয়নি বরং আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ট্যানারির সিইপিটি এবং বলিয়ারপুরে ডাম্পিং স্টেশন এখনও পর্যন্ত কার্যকরী হয়নি। অনেক শিল্পকারখানায় ইটিপি থাকলেও ব্যবহার করা হয়না। সাভার পৌরসভা এবং অন্যান্য সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান তাদের সকল বর্জ্য মহাসড়কের উভয় পাশে ডাম্পিং করে যাচ্ছে। এসব কিছু মিলিয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে সাভার।

দখলের কবলে পড়ে সাভার নদ/নদী ও খাল/বিলগুলি প্রবাহ শূণ্য হয়ে পড়ছে এবিষয়ে তিনি বলেন, প্রায় সময়ই উপজেলা এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব জলাশয় দখলকারীদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়, কিন্তু সেগুলি দখলমুক্ত করতে নেয়া হয়নাই তেমন কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা। ফলে নতুন নতুন ভূমি দস্যুরা আবারো নব উদ্যমে নদী ও খালের অংশ দখল করায় মেতে উঠে।

সদ্য যোগদান করা সাভার উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নাই বিধায় এব্যাপারে তার বক্তব্য পাওয়া যায় নাই। তবে আশুলিয়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ এর কাছে এই অবৈধ দখলদারিত্বের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জানান, বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বার্তাবাজার/ডব্লিওএস

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর