ব্যর্থতার দায়ে পদত্যাগের সংস্কৃতি কবে হবে?

আমাদের বাংলাদেশে একটা করে দুর্ঘটনা ঘটে, ঘটার পর হইচই পড়ে যায়। সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা কথামালার ফুলঝুরি ঝরান, বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করার আশ্বাস দেন। কোথায় অনিয়ম হয়েছে তাঁর লম্বা ফিরিস্তি দেন। কিন্তু ঘটনা থিতিয়ে পড়লেই যে যার অবস্থানে ফিরে যান। অনিয়ম বহাল তবিয়তে থাকে, সেগুলোর কোনো সুরাহাও হয় না। অনিয়ম আরও বেড়ে যায়।

চকবাজারের পর বনানীর এফআর টাওয়ারের ঘটনা আমাদেরকে সেকথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। নিমতলীর ঘটনার আগে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র যে কথাগুলো বলেছিলেন, যে আশ্বাস দিয়েছিলেন তাঁর একটিও তিনি চুড়িহাট্টার ঘটনার আগে বাস্তবায়ন করেননি। এ দায় তিনি কীভাবে এড়াবেন? এজন্য কি তিনি পদত্যাগ করবেন? চুড়িহাট্টার ঘটনার পরও টুকটাক কিছু অভিযান চললেও সেগুলো এখন থেমে গেছে। এখনও সেখানে বাণিজ্যিক কাজকর্মে কেমিক্যাল, গোডাউন ব্যবহৃত হচ্ছে বলে এলাকার লোকজন জানিয়েছেন। তাহলে কি আরেকটা দুর্ঘটনা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? আবার একটি দুর্ঘটনা ঘটলে দক্ষিণের মেয়র জনগণকে কী বলে আশ্বস্ত করবেন? কত মৃত্যু এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করবে?

এবার আসা যাক অভিজাত এলাকা বলে পরিচিত বনানীর এফআর টাওয়ারের ঘটনায়। এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরদিন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী স্যুট-টাই পরে পর্দার সামনে এলেন এবং তিনি আইনস্টাইনের আবিষ্কারের মত করে বললেন যে, এই ভবনের অনুমোদন ছিল ১৭ তলা কিন্তু তারা নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ২২ তলা নির্মাণ করেছেন। তাহলে কি রাজউক নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিল? ১৭ তলা ভবন ২২ তলা ভবনে পরিণত হলো অথচ রাজউক এতদিনে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলো না কেন? এরকম বক্তব্য দেয়ার পূর্বে তিনি কি রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন? আমরা খুশি হতাম যদি তিনি ব্যবস্থা নিয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়ে একথাগুলো বলতেন।

শুধু তাই নয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ হরহামেশাই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে, নকশা বহির্ভূত ঘরবাড়ি-স্থাপনা ভেঙে ফেলার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু এফআর টাওয়ারের মত বিপজ্জনক ভবনগুলো দাঁড়িয়ে থাকে বহাল তবিয়তে। কি জাদুমন্ত্র বলে তারা রাজউকের বিচারের বাইরে থেকে যায় সেটা একটা বড় প্রশ্ন। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী কি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও পদত্যাগের সংস্কৃতি নাই। কিন্তু এই ঘটনার পর যারা দায়িত্বে আছেন, যারা এই ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না তাঁদের পদত্যাগ করা উচিৎ কিনা সেই প্রশ্ন জনমনে উঠছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বা নকশা যিনি অনুমোদন করেন বা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী কি পদত্যাগ করবেন?

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনের আগে বলেছিলেন যে, একটি নিরাপদ ঢাকা তৈরি করবেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি কী করেছেন সে সম্পর্কে জনগণ এখন পর্যন্ত অবহিত নয়। আমরা জানি যে ঢাকার অভিজাত এলাকা বলে পরিচিত গুলশান, বনানী, বারিধারাতে এরকম আশ্বাস মেয়রসহ কর্তাব্যক্তিরা অন্তত তিনবার দিয়েছিলেন।

১. যখন হোলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটলো তখন সিটি কর্পোরেশন ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হলো যে, আবাসিক এলাকায় কোনো অনোনুমোদিত কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা অফিস থাকবে না। সেই অনোনুমোদিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এখন নতুন করে হচ্ছে। গুলশান বনানী এখন আর আবাসিক এলাকা নাই, একটা বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হয়েছে। অথচ রাজউকের নাকের ডগায় ঘটনাগুলো ঘটছে। অলিগলিতে গড়ে উঠছে বিভিন্ন হাসপাতাল, কলকারখানা। বনানী বা গুলশান নিজেই একটি অগ্নিকুণ্ডের অবস্থায় রয়েছে। যেকোনো সময় এখানে যেকোনো জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

২. রেইনট্রিতে যখন একটি তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলো তখন দেখা গেল যে, রেইন্ট্রি হোটেলটি একটি অবৈধ স্থাপনা। তখন রাজউকের পক্ষ থেকে এবং সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো অবিলম্বে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু সেই রেইন্ট্রি এখনও রাজউককে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বহাল তবিয়তে আছে। আর কত ঘটনা ঘটলে রেইন্ট্রির মত অবৈধ স্থাপনাগুলোর দিকে দৃষ্টি পড়বে সরকারের?

৩. চকবাজারের ঘটনা যখন ঘটলো তখন সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হলো যে, উত্তরের সমস্ত ভবনগুলোতে অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা আছে কিনা সে ব্যাপারে রিপোর্ট দিতে হবে। কিন্তু চুড়িহাট্টার ঘটনার পর প্রায় একমাসের বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে এখন পর্যন্ত কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রিপোর্ট দিয়েছে বলে জানা যায়নি।

এখানে যারা অনিয়মগুলো করছে তারা তো অন্যায়কারী তাঁদের বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা হবেই কিন্তু এই অনিয়মে যারা মদদ দিচ্ছে, যাদের কারণে অনিয়মগুলো প্রশ্রয় পাচ্ছে, যাদের কারণে অনিয়মগুলোর ব্যাপকতা বাড়ছে তাঁদেরকে শাস্তির আওতায় আনবে কে? তারা কি আইনের ঊর্ধ্বে? আর এই ব্যর্থতার জন্য কি বাংলাদেশে পদত্যাগের সংস্কৃতি চালু হবে? কেউ কি পদত্যাগ করে দেখাবেন যে তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন? তিনি শুধু কথা বলেছেন, দায়িত্ব পালন করতে পারেননি? এজন্য তিনি পদত্যাগ করছেন।

— বাংলা ইনসাইডার

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর