এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়

আমরা আজ কোথাও কেউ নিরাপদ নই। বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, সড়ক কোথাও কেউ নিরাপদ নয়। এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়। নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন মানুষ কঙ্কাল হয়েছে। ডিএনএ টেস্ট করে লাশ শনাক্ত করতে হয়েছে। এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর বিভীষিকাময় পরিস্থিতি দেখে আমরা তদন্ত কমিটি করেছি। গণমাধ্যমে তোলপাড় করেছি। নানান পরিকল্পনা নিয়েছি। কিন্তু মানুষের বসবাস-উপযোগী নগরী গড়ে তুলতে পারিনি। পুরান ঢাকাকে ঘিঞ্জি গলি, অপরিকল্পিত, সেকেলে ভবন ও রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থের মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের মৃত্যুফাঁদ বলেছি। কিন্তু ১০ বছরেও সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা মানুষের জীবন নিরাপদ, বসবাস-উপযোগী করতে পারিনি। একের পর এক ঘটনায় দায়িত্বশীল মহলসহ সচেতন নাগরিকসমাজও বেমালুম ভুলে গেছি। যার যার স্বার্থে যার যার হিসাব-নিকাশে পথ হেঁটেছি। যে মা সন্তান হারিয়েছেন, যে পিতা তার কন্যা হারিয়েছেন, যে সন্তান তার মা-বাবা হারিয়েছেন বা পরিবার পুড়ে অঙ্গার হয়েছে কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে; তিনিই কেবল সেই বেদনার ক্ষতের যন্ত্রণা উপলব্ধি করেছেন। নিমতলীর ভয়াবহতা থেকে আমরা নিরাপদ হতে পারিনি বলে, হৃদয় পুড়ে অভিজ্ঞতা নিয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারিনি বলে চুড়িহাট্টার আগুনের দাউদাউ সর্বনাশা রূপ প্রত্যক্ষ করেছি। সেখানে ৭১ জন মানুষ কঙ্কাল হয়েছে। বাতাসে মানুষ পোড়ার গন্ধ ছড়িয়েছে। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে মাতম উঠেছে। স্বজন হারানোর বেদনায় যন্ত্রণাকাতর মানুষ আর্তনাদ করেছে। এ দুটি ভয়াবহ ঘটনা ছাড়াও নানা জায়গায় হামেশাই আগুনে পুড়ছে মানুষ। চুড়িহাট্টার অভিশাপে স্বজন হারানোর কান্না ভুলে যেতে না যেতেই ঢাকা নগরীর সবচেয়ে অভিজাত এলাকা বনানীতে বহুতল ভবনে দাবানলের মতো আগুন ছড়িয়েছে। মানুষের বাঁচার কি আকুতি তার মর্মস্পর্শী চিত্র যেমন মানুষ দেখেছে, তেমনি দেখেছে আকাশছোঁয়া এফআর ভবনটিতে অগ্নিকাে কীভাবে মানুষ পুড়ছে। কীভাবে যুদ্ধ করে ফায়ার সার্ভিসের বীর কর্মীরা এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আগুন নিভিয়েছেন। কীভাবে তাদের সঙ্গে মানুষ বাঁচাতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা লড়েছেন। জীবন্ত মানুষ উদ্ধার করেছেন। এখানে বিদেশির মৃত্যু হয়েছে। যুগল দম্পতির মৃত্যু হয়েছে। কেউ প্রাণ বাঁচাতে উঁচু ভবন থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। কেউবা আগুনে পুড়ে মরেছেন। বহুতল ভবনটি ১৮ তলার অনুমতি নিয়ে মালিকপক্ষ মুনাফার লোভে ২৩ তলা নির্মাণ করেছে। আর সেটি বাণিজ্যিক ভবনে পরিণত হয়েছে। যেখানে অনেক সংস্থার নিয়ম মেনে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থাসহ বহির্গমনের বিকল্প পথ রাখা হয়নি। সিঁড়িপথ ছিল আয়তনে ছোট।

সাভারে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি রানা প্লানা ধসে পড়ে মানুষের হৃদয়বিদারক জীবন্ত সমাধি হতে দেখেছি। দাবি উঠেছিল ঝুঁকিমুক্ত ভবন নির্মাণের, সব আইন মেনে ভবন নির্মিত হয়েছে কিনা তা মনিটরিংয়ের। গার্মেন্ট খাতের ভবনগুলো অনেকটাই নিরাপদে এসেছে। কিন্তু ঢাকা নগরীর সব আবাসিক এলাকায় আকাশছোঁয়া বাণিজ্যিক ভবনগুলো একের পর এক যেমন রাজউকের অনুমোদিত নকশা লঙ্ঘন করেছে, তেমনি ঝুঁকিমুক্ত ভবন নির্মাণে নিয়মকানুনের তোয়াক্কাই করেনি। একটির সঙ্গে আরেকটি পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে বাণিজ্যিক ভবন। সেসব ভবনে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থাসহ দুর্ঘটনাকালে মানুষকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য বিকল্প পথ রাখা হয়নি। ২৩ তলার আগুনে পোড়া মৃত মানুষের ধ্বংসস্তূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গোটা দেশের মানুষের বেদনা ও অভিশাপের প্রতীক হয়ে ওঠা বনানীর এফআর টাওয়ার যে নির্মাণকালে রাজউকসহ সব সংস্থার আইন-বিধিবিধান লঙ্ঘন করে এত দিন পাপ বহন করছিল তা দেখার যেন কেউ ছিল না। না রাজউক, না অন্য কেউ। এখন এ-ওকে দোষারোপ করছে। একেকটি দায়িত্বশীল মহল নিজেদের ধোয়া তুলসী পাতা বলে জাহির করছে। আর বিশেষজ্ঞরা গণমাধ্যমে তাদের সব জ্ঞানের পরিধি ঢেলে দিচ্ছেন। তদন্ত কমিটি হয়েছে। ইতিহাসে অনেক ঘটনার তদন্ত কমিটি হয় কিন্তু মানুষের ভাগ্য বদল হয় না। নিরাপদ জীবন যাপন হয় না। মানুষের বছরের পর বছর আকুতিভরা কণ্ঠে উচ্চারিত ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যরান্টি চাই’Ñ আর পাওয়া হয় না। সড়কে মৃত্যুর মিছিল। মুনাফালোভী ফিটনেসবিহীন গাড়ির মালিক, দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রাফিকব্যবস্থা, উন্নাসিক লাইসেন্সবিহীন ও অপরিপক্ব কিংবা নেশাখোর বাসচালক ও হেলপারদের বেপরোয়া ছুটে চলা বাসের তলায় পিষ্ট হচ্ছে ছাত্রছাত্রী, সাধারণ মানুষ। সড়কে মানুষ মরে ঘাতক বাসের হত্যাকাে র শিকার হয়ে, বাড়িতে মানুষ মরে দুর্বৃত্তের হামলায় অথবা ভয়াবহ আগুনের লেলিহান শিখায়। কর্মস্থলে জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে লাশ হয়ে বাড়ি ফেরে একের পর এক মানুষ। লাশের চেহারা চেনা যায় না। স্বজনের কান্না থামে না। আকাশ-বাতাস বেদনায় ভারি হয়। অশ্রু ঝরে কত শত মায়ের। একটা পথশিশু বনানীর আগুনে ছুটে যায় মানুষ বাঁচাতে। কিন্তু কি দুর্ভাগ্যের বিষয়, আগুনের ভয়াবহ দাউদাউ রূপে মানুষ পুড়ে মরে। রাষ্ট্রের ঘুম ভাঙে না। দুর্নীতিগ্রস্ত দায়িত্বশীল মহল নকশার নামে, অনুমোদনের নামে পকেট ভারী করে। মালিকরা মুনাফা লোটে। কিন্তু মানুষের কর্মস্থল নিরাপদ হয় না। ব্যবসায়ীরা ভাড়া নেওয়ার সময় ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ কিনা, দুর্ঘটনা ঘটলে প্রাণ নিয়ে বের হয়ে আসতে পারবেন কিনাÑ এসব চিন্তা না করেই চড়া মূল্যে ভাড়া নেন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম যেখানে নিয়মে পরিণত হয় মানুষ সেখানে অনিয়মেই বাস করতে শিখে যায়। একের পর এক পথে একেকটি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় এত এত মানুষের মৃত্যু তবু আমাদের সবার বোধ আসে না। কি সরকার কি সরকারি সংস্থা, কি দায়িত্বশীল মহলÑ কেউ মানুষের জীবনের নিরাপত্তাবিধানে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারে না। উদাসীন মহলের কারণে আইন-বিধিবিধান লঙ্ঘনে সবখানে চলছে চরম ঔদ্ধত্যপনা। নিমতলীর পর মানুষ দেখেছে চুড়িহাট্টার ভয়াবহতা। চুড়িহাট্টার পর দেখল বনানীর আগুনের ভয়াবহ রূপ। এখন আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের প্রশ্নÑ এরপর কোথায় ঘটছে দুর্ঘটনা? কোথায় লাগছে আগুন? কোথায় মরছে মানুষ? কারণ, এই জাগতিক পৃথিবীতে স্বাধীনতার ৫০ বছরের দোরগোড়ায় এসেও সবকিছুর দাম বাড়লেও কেবল কমেছে মানুষের জীবনের মূল্য। তাই মানুষ মরছে চারদিকে। সড়কে মানুষ হত্যার ভয়াবহ রূপ, বাসাবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দাবানল থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছে না। জীবিকার তাগিদে ঢুকছে, আগুনে পুড়ে লাশ হয়ে ফিরছে। বাতাসে আজ তাই লাশের গন্ধ। জীবনে আজ মানুষ বড়ই নিরাপত্তাহীন। এ নগরীকে, এ দেশকে মানুষের বসবাস-উপযোগী, নিরাপদ, জীবনের জন্য সকল দুর্নীতির পথ রুখে দিয়ে আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী সব মহলের দায়িত্ব পালন এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আকাশছোঁয়া ভবন কেবল ঢাকাতেই নয়, নগরসভ্যতায় ঢাকার বাইরেও বড় বড় নগরীতে হচ্ছে। প্রয়োজনে লোকবল বাড়াতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ আনতে হবে। ভবন নির্মাণে ও মনিটারিং-ব্যবস্থায় দায়িত্বশীলদের সৎ ও সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে। জনগণকেও সচেতনতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের বীর কর্মীরা প্রতিটি অগ্নিকাে জীবন বাজি রেখে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন মানবিক হৃদয় ও সাহস নিয়ে সততার সঙ্গে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নেই। কিন্তু যে কোনো অগ্নিকাে তাদের দ্রুত গিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবেশ কেন থাকে না? কেন পানি সংকটের মুখোমুখি হতে হয়? কেন উৎসাহী মানুষের ভিড়ে তাদের গাড়ি প্রবেশে বিলম্ব হবে? দায় সমাজকেও নিতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সততা, দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারলে, আইনের দায়িত্ব মাথায় তুলে নিতে পারলে কেন একেকটি ভবনের নকশা অনুমোদনকারীরা ও ভবন মালিকরা আইন মাথায় নিয়ে সততার সঙ্গে দক্ষতার অগ্নিপরীক্ষা দেবেন না? এ ধরনের দুর্ঘটনায় এত এত মানুষের করুণ মৃত্যুর জন্য প্রতিটি দায়িত্বশীল সংস্থার কর্তারা দায় এড়াতে পারেন না। আমরা নিরাপদ জীবন চাই। নিরাপদ কাজের পরিবেশ চাই। মানুষ আজ নিরাপদে যাতায়াত করতে চায়। ঘর থেকে সড়ক হয়ে কর্মস্থল পর্যন্ত সব জায়গায় নিñিদ্র নিরাপত্তা চায়। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা রাষ্ট্রকে দিতেই হবে। এ আমাদের লাখো লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীন দেশের সংবিধান-প্রদত্ত প্রাপ্য। এ পাওনা রাষ্ট্রকে পরিশোধ করতেই হবে। আইন লঙ্ঘনকারী সবাইকে আইনের আওতায় আনার কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বিজিএমইএ ভবন যদি ভেঙে দেওয়া যায়, র‌্যাংগস টাওয়ার যদি গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় রাষ্ট্র ও সরকারের চাইতে কার এত বড় হাত যে আইন লঙ্ঘন করে আকাশছোঁয়া ভবন তৈরি করবে? কার এত বড় সাহস সেই ভবন ভাড়া দেবে বা ফ্লোর বিক্রি করবে? আর সেখানে অনুমতি ছাড়া আগুনের স্পর্শ পেলে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা সামগ্রী দিয়ে ডেকোরেশন করবে কিংবা যেখানে সেখানে দাহ্য পদার্থ রাখবে?

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর