ডেঙ্গু জ্বরের আদি-অন্ত

ডেঙ্গু জ্বরের ইতিহাসঃ
‘ডেঙ্গু’ নামটি আফ্রিকার সোয়াহিলি ভাষার প্রবাদ কা-ডিঙ্গা পেপো থেকে এসেছে। ওই শব্দের অর্থ শয়তানের শক্তির কাছে আটকে যাওয়ার মতো ব্যথা। ডেঙ্গু রোগের প্রথম উল্লেখ পাওয়া গেছে চীনের চিকিৎসা সংক্রান্ত নথিপত্রে। চীনে এই রোগটি ৯৯২ খৃীষ্টাব্দে শনাক্ত করা হয়েছিল।
এই জ্বরকে শনাক্ত এবং ডেঙ্গু জ্বর বলে নামকরণ করা হয় ১৭৭৯ সালে। এরপরের বছর প্রায় একই সময়ে এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকায় ব্যাপকভাবে দেখা যায়। শরীরে ব্যথার কারণে তখন একে ‘হাড়ভাঙ্গা জ্বর’ বলেও ডাকা হতো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানে, মহামারী আকারে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৫০ সালের দিকে ফিলিপিন্স এবং থাইল্যান্ডে। ১৯৭০ সালের আগে মাত্র নয়টি দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা গিযয়েছিল। বিশ শতকের শেষ ২৫ বছরে এই রোগটির ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটে।

ডেঙ্গু জ্বরের কারণঃ
বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। এটা ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার মাধ্যমে আক্রান্ত মানুষের শরীর থেকে অন্য মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। প্রবেশের পর এ ভাইরাস শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রদাহের সৃষ্টি করে। তবে সবচেয়ে বেশি আঘাত হানে রক্তনালি, লিভার এবং শরীরের ইমিউন সিস্টেমে (রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা)। রক্তনালি থেকে প্রচুর জলীয় অংশ/প্লাজমা রক্তনালির বাইরে চলে আসে। ফলে রক্তের পরিমাণ ও রক্তচাপ কমে যায়। শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, বিশেষ করে ব্রেন, কিডনি, লিভার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্তপ্রবাহ কমে যায়। লিভারে প্রদাহের দরুন সেখান থেকে নিঃসৃত রক্ত জমাট বাঁধার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনের ঘাটতি পড়ে। এ ছাড়া রক্তের ভেতর রক্ত জমাট বাঁধার আরেকটা প্রয়োজনীয় উপাদান প্লাটিলেটের ঘাটতি পড়ে যায়। এসব কিছুর সামগ্রিক প্রভাবে আক্রান্ত ব্যাক্তি অসুস্থ হয়ে পড়ে। নাড়ির গতি, রক্তচাপ কমে শকে চলে যেতে পারে, যা জীবনের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। শরীরের বিভিন্ন জয়গা থেকে রক্তপাত হতে পারে। রক্তনালি থেকে বের হয়ে আসা প্লাজমা/পানি ফুসফুস, পেটসহ শরীরের বিভিন্ন জয়গায় জমে যায়। রক্তচাপ কমে গিয়ে বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে এবং মাল্টিঅরগান ফেইলিউর হতে পারে। উল্লেখ্য বাংলাদেশে এবছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রন্ত হয়েছে প্রায় ৫০,০০০ হাজারেরও বেশি মানুষ। মারা গিয়েছে প্রায় ১০০ জন।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষনসমূহঃ
মাথা বা শরীরের ব্যথা ও প্রচ- ক্ষুধামন্দা ও বমি বমি ভাব।
বমি, পাতলা পায়খানা, পেটে ব্যথা এমনকি খিঁচুনি হওয়া।
শরীরের বিভিন্ন জয়গায় রক্তপাতের চিহ্ন, যেমন মাড়ি বা নাক থেকে রক্ত পড়া।
পেট ফুলে যাওয়া, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হওয়া।
শরীরে রশ আসা। তবে এবারের জ্বরে এই লক্ষনটি কম।
জ¦ও প্রায় ১ থেকে ৫ দিন পর্যন্ত থাকলে।
মাসিকের সময় কিশোরী মেয়েদের বেশি রক্তপাত হওয়া।
হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসা।
৬-৭ ঘণ্টা প্রস্রাব না হওয়া।
চোখের সাদা অংশে রক্তের ছাপ দেখা যাওয়া।
উপরেে লক্ষনগুলো দেখা দিলে দেরি না করে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা।

ডেঙ্গু জ্বর হলে করনীয়ঃ
জ্বর বা শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার পর রোগটি সংকটপূর্ণ অবস্থায় চলে যেতে পারে। তাই জ্বর কমে গেলেও নজর দিতে হবে।
তরল খাবার, পানি, খাওয়ার স্যালাইন, ডাবের পানি, শরবত, স্যুপ ইত্যাদি বেশি করে পান করতে হবে মুখে যত পারা যায়।
ছয় ঘণ্টার মধ্যে প্রস্রাব না হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ভালো।
নিয়মিতভাবে নাড়ির গতি, রক্তচাপ মাপা জরুরি। তাই কাছের চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নিতে হবে।
প্রতি মুহূর্তেই বিপদচিহ্নগুলো খেয়াল করা এবং তা পেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যোগাযোগ কওে ডেঙাগু জ্বরের পরীক্ষা করা।

ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে সচেতনতাঃ
পরিষ্কার পানিতে ডেঙ্গু মশা জন্মায়। তাই সাত দিন পর পর ফ্রিজের নিচের, এসির নিচের জমে থাকা পানি পরিষ্কার করা।
ফুলের টব থাকলে সেখানে যেন ময়লা পানি না জমে।
মশার কামড় থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
ফুলহাতা জামাপ্যান্ট, মোজা পরা।
দিনের বেলায়ও মশারি দিয়ে ঘুমানো।
বাড়িকে মশামুক্ত রাখা।
বাইরে যাওয়ার সময় ত্বকে মশা নিরোধক ক্রিম লাগানো।
বাড়িতে কারও ডেঙ্গু হলে তাকে সর্বক্ষণ মশারির ভেতর রেখে যতœ নিন, যাতে রোগ ছড়াতে না পারে।
এডিস মশা সাধারণত সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে অন্য সময় ও কামড়াতে পারে। তাই দিনে ঘরের চারদিকে দরজা জানালায় নেট লাগাতে হবে।
সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তবে জটিলতা দেখা দিলে, সেই ক্ষেত্রে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে বলে পরামর্শ তাঁর।
সামাজিক বনায়ন খুবই জরুরি, এতে পরিবেশের ভারসাম্য যেমন রক্ষা হয়, তেমনি এডিস মশার প্রজনন অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। এমনভাবে বাড়ির ডিজাইন করা উচিত নয়, যাতে পানি যাওয়ার রাস্তা ব্যাহত হয়।
জ্বরে হলে কোন ধরণের এন্টিবায়োটিক ও ননস্টেরয়ডাল, প্রদাহপ্রশমী ওষুধ সেবন করা যাবে না।
মসকুইটো রিপেলেন্ট, স্প্রে, লোশন বা ক্রিম, কয়েল, ম্যাট ব্যবহার করা যেতে পারে।

ডেঙ্গু মশা যেভাবে ছড়ায়ঃ
বাংলাদেশে সাধারণত মে থেকে সেপ্টেম্বরকে বলা হয় ডেঙ্গুর সময়। বর্ষাকালে এ মশা ডিম পারে। এটি হলো ডেঙ্গুর প্রজনন মৌসুম। ফিমেল ইজিপ্টি মশা ডেঙ্গু জ্বরের বাহক। একটি মশা যখন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড় দেয় তখন ভাইরাসটি মশার মধ্যে প্রবেশ করে। সংক্রামিত মশা যখন অন্য ব্যক্তিকে কামড় দেয় তখন ভাইরাসটি সেই ব্যক্তির রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে। এজন্য প্রথমে সতর্ক থাকতে হবে, যেন মশা আমাদের না কামড়াতে পারে।

ডেঙ্গু শক সিনড্রোমঃ
ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম। এর লক্ষণ হল – রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া। নাড়ির স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হয়। শরীরের হাত পা ও অন্যান্য অংশ ঠা-া হয়ে যাওয়া। হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলা। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ডেঙ্গু রোগীকে রক্তদানে রক্তদাতার করনীয়ঃ
ডেঙ্গু রোগে রক্তের প্রয়োজন হয়। ডেঙ্গু রোগীকে যিনি রক্ত দেবেন তাঁর কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবেঃ
রক্ত জমাট না বাঁধার কোনো ওষুধ খেলে কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা রক্তদান থেকে বিরত থাকতে হবে।
একেবারে খালি পেতে রক্তদান কেন্দ্রে যাওয়া উচিত নয়, বিশেষ করে চার ঘণ্টার বেশি গ্রহণযোগ্য নয়।
কারো যদি প্লাটিলেট লাগে, তবে তার রক্তদাতাকে দুই ঘণ্টার মধ্যে ভারী খাদ্য গ্রহণ করা উচিত নয়। এতে প্লাটিলেটের কাজ কমে যায়।

ডেঙ্গু জ্বরের টিকাঃ
ডে জ্বর প্রতিরোধী টিকা কয়েকটি দেশে অনুমোদিত হয়েছে। তবে এই টিকা শুধু একবার সংক্রমিত হয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কার্যকর।

ডেঙ্গু জ্বর হলে যেসব খাবার খেতে হবেঃ
পেঁপে পাতা, বেদানা, ডাবের পানি, হলুদ, মেথি, কমলা, পালং শাক।
ডেঙ্গু জ্বর হলে যেসব খাবার খাবেন নাঃ
বেশি তেলে ভাজা খাবার, চা-কফি, ফাস্টফুড জাতীয় খাবার।
যেসব ঔষধ খাওযা উচিত নয়ঃ
ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। স্বাভাবিক ওজনের একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ চারটি প্যারাসিটামল খেতে পারবে।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গুর সময় অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ গ্রহণ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
কোন ধরণের এন্টিবায়োটিক ও ননস্টেরয়ডাল, প্রদাহপ্রশমী ওষুধ সেবন করা যাবে না।

দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু জ্বর হলে করনীয়ঃ
ডেঙ্গু জ্বর প্রথমবার হলে বেশি জটিল হয় না। যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি অনেক বেশি। যাদের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হচ্ছে, তারা আগে সম্ভবত আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। এ জন্য রোগীদের প্রতি পরামর্শ, যেহেতু বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি, তাই যেকোনো ধরনের জ্বর হলে অবহেলা করা যাবে না। সামান্য জ্বর হলেও তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং ডেঙ্গু হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। বিশেষ করে যারা প্রথমবার আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলেই ঝুঁকিটা অনেক বেশি। তাই এ ধরনের রোগীদের খুবই সতর্ক থাকতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, ডেঙ্গু জ্বর পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়, এর কোনো ভ্যাকসিন কিংবা কার্যকরী ঔষধও আবিষ্কৃত হয়নি। মশক নিধনই বর্তমানে ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। সরাসরি ডেঙ্গু ভাইরাসকে লক্ষ্য করে ওষুধ উদ্ভাবনের গবেষণা চলমান রয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরের মশাটি আমাদের দেশে আগেও ছিল, এখনো আছে, মশা প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে। একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

বার্তাবাজার/এস.আর

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর