আমার যা-ই হোক, এর শেষ দেখে ছাড়বো আমি

মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের পর আগুনে পুড়িয়ে হত্যায় দায়ের করা মামলায় তার বাবা একেএম মুসা, চাচাতো ভাই মুহাম্মদ আলী ও মামা সৈয়দ সেলিমের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে।

সোমবার (২৯ জুলাই) ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে উপস্থিত হয়ে তারা সাক্ষ্য দেন। ফেনী জেলা জজ আদালতের সরকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) হাফেজ আহাম্মদ বলেন, নুসরাত হত্যা মামলায় ৯২ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত বাদীসহ ৬১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে। মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) ডা. সোহেল মাহমুদ, ডা. প্রদীপ বিশ্বাস, ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস, ডা. আবু তাহের, ডা. আরমান বিন আব্দুল্লাহ, ডা. মোহাম্মদ ওবায়দুল ইসলাম, ডা. একেএম মনিরুজ্জামান, অর্চনা পাল ও জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. জাকির হোসাইনের আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার কথা রয়েছে।

আদালত সূত্র জানায়, সাক্ষ্য দেওয়ার সময় নুসরাতের বাবা একেএম মুসা বলেন, গত ২৭ মার্চ আমি কর্মস্থলে ছিলাম। আমার স্ত্রী মোবাইলে জানায়, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা দপ্তরি নুরুল আমিনকে দিয়ে আমার মেয়ে নুসরাতকে তার রুমে ঢেকে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেন।

খবর পেয়ে পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে থানায় নিয়ে আসে। ওইদিন আমার স্ত্রী মামলা দিলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পরে শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের ও আফসার উদ্দিন মামলা তুলে নিতে আমার ছেলেদের হুমকি দেন। ৬ এপ্রিল নুসরাতকে নিয়ে আমার বড় ছেলে নোমান পরীক্ষার হলে গেলে, তাকে (নোমান) ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

কিন্তু এর আগের দু’টি পরীক্ষায় অসুস্থতার কারণে সে নুসরাতকে হলে বসিয়ে এসেছে। ওইদিন আমার স্ত্রী ফোন করে জানায়, কে বা কারা নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়েছে। আমার স্ত্রীসহ দুই ছেলে তাকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে। তাৎক্ষণিক আমি কর্মস্থল থেকে বাড়ি গিয়ে এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে যাই।

তিনি বলেন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার মেয়ে প্রথম দুইদিন কথা বলতে পারতো। এসময় নুসরাত বলেছিল, আমার যা-ই হোক, এর শেষ দেখে ছাড়বো আমি। এমনকি কীভাবে তার গায়ে আগুন দেওয়া হয়েছে, সেটাও সে আমাদের বলেছে।

সে বলেছে, পরীক্ষা দিতে হলে প্রবেশ করলে, অধ্যক্ষের ভাগনি তুহিন তাকে (নুসরাত) জানায় সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিশাতকে কারা যেনো মারছে। এটা শুনে ছাদে গিয়ে বোরকা, হাত মোজা ও চশমা পরা চারজনকে দেখতে পায় সে। একজন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়।

একজন তার মুখ চেপে ধরে হাত-পা বেঁধে ফেলে। আরেকজন তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাদের গলার স্বর চেনা চেনা লাগছিল। তবে পুরোপুরি চিনতে পারেনি বলে নুসরাত জানায়। কিন্তু তারা একজনকে শম্পা বা চম্পা বলে ডাক দেয় বলে জানায় সে। পরে ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার মেয়ে মারা যায়। পরদিন হাসপাতালের মর্গে তার সুরতহাল রিপোর্ট হলে তাকে নিয়ে আসি। ১১ এপ্রিল সোনাগাজীর সাবের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে তার মরদেহ দাফন করি।

নুসরাতের চাচাতো ভাই মুহাম্মদ আলী সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেন, গত ৬ এপ্রিল সাড়ে ৯টার দিকে আমার বড় ভাই ওমর ফারুক ফোন দিয়ে জানায়, নুসরাতের গায়ে কে বা কারা আগুন দিয়েছে। আমি দ্রুত হাসপাতালের গেটে গিয়ে জানতে পাড়ি তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছে।

সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢামেক হাসপাতালে নিতে হবে। আমি, নোমান, রায়হান ও আমার চাচি মিলে তাকে ঢাকায় নিয়ে যাই। ১০ এপ্রিল সন্ধ্যায় আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। আমরা কুমিল্লা পৌঁছলে জানতে পাড়ি নুসরাত মারা গেছে। ওইদিন রাতে তার মরদেহ হিমাগারে রাখা হয়।

পরদিন নুসরাতের মরদেহের সুরতহাল রিপোর্টের জন্য একটি নথি নিয়ে শাহাবাগ থানায় যাই। সে কাগজ হাসপাতালের কর্মকর্তাদের দিলে তারা মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করেন। আমি তাতে স্বাক্ষর করি।

পরে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে নুসরাতের দূর সম্পর্কের মামা সৈয়দ আলম বলেন, গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতারের পর তার অনুগত শাহাদাত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিনসহ আরও অনেকে অধ্যক্ষের মুক্তির জন্য মানববন্ধন করেন।

এছাড়া মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহ সভাপতি রুহুল আমিন ও কাউন্সিলর মাকসুদ আলম মাদ্রাসায় গিয়ে অধ্যক্ষের মুক্তির জন্য ছাত্রছাত্রীদের যা করার দরকার, তা করতে বলেন। পরে ৬ এপ্রিল অধ্যক্ষের নির্দেশে নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামিম, জাবেদ, জোবায়ের, কামরুন নাহার মনি ও উম্মে সুলতানা পপিসহ তাদের সহযোগীরা পরিকল্পিতভাবে নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়ে এটাকে আত্মহত্যা বলে প্রচারের চেষ্টা চালান।

পরে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আমি তার চিকিৎসার কাজে সহায়তা করি। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল রাতে তার মৃত্যু হয়। পরদিন সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে হাসপাতালের মর্গে মরদেহ পাঠায়। আমি সুরতহাল রিপোর্টে স্বাক্ষর করি।

চলতি বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়ের অভিযোগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৬ এপ্রিল ওই মাদরাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে অধ্যক্ষের সহযোগীরা নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেন। টানা পাঁচদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মারা যান নুসরাত জাহান রাফি।

এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ১৬ জনের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে।

এ মামলায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের ও জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।

বার্তা বাজার/কেএ

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর