কিশোর সিজানকে খুন করে উল্লাসে মেতে ওঠে ছয় সন্দেহভাজন খুনি

পনেরো বছরের কিশোর সিজান হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন সন্দেহভাজন খুনি ইমন (১৯) ও মুন্না মিয়া (১৮)। গত বুধবার ঢাকার আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার পর তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) উপপরিদর্শক আল আমিন শেখ আজ শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘কিশোর সিজানকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। আদালতকে বিস্তারিত জানিয়েছে এই দুই আসামি। খুন করার পর বাসায় গিয়ে কুখ্যাত খুনি এরশাদ শিকদারের গান ছেড়ে তাঁরা সারা রাত উল্লাস করে।’

পুলিশ কর্মকর্তা আল আমিন শেখ বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী ইমন সিজানের ঘাড়ে হাত দিয়ে হাঁটতে থাকে। ইমনের ইশারা পেয়ে পেছন থেকে পুঁটলা সিফাত নামের আরেকজন প্রথমে সিজানের পিঠে ছুরিকাঘাত করে। বাঁচার জন্য দৌড় দিলে মুন্না লাথি মেরে তখন সিজানকে ফেলে দেয়। এরপর ইমনসহ ছয়জন সিজানকে উপর্যুপরি কুপিয়ে জখম করে ফেলে রেখে যায়। এরপর তারা পুঁটলা সিফাতের বাসায় যায়। খুনি এরশাদ শিকদারের গান ছেড়ে তখন তারা উল্লাস করে। এর প্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে।’

সিজানের মা নাসরিন বেগম শনিবার বলেন, কাজ শেষে ৭ মার্চ রাত ৮টার দিকে বাসায় আসে তাঁর ছেলে। খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমানোর জন্য সে বিছানায় যায়। রাত সাড়ে ১১টার সময় সিজানের মোবাইলে কল আসে। সঙ্গে সঙ্গে বাসা থেকে বের হয়ে যায় সে। যাওয়ার আগে সে বলেছিল, বাসার সামনে যাচ্ছে, এক্ষুনি ফিরবে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে অজ্ঞাত নম্বর থেকে সিজানের বাবা মুকুল মিয়ার মোবাইলে ফোন আসে। ওই লোকটি বলেছিলেন, সিজান ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন। তার রক্তের প্রয়োজন। রাত দুইটার দিকে সিজান হাসপাতালে মারা যায়।

এ ঘটনায় সিজানের বাবা মুকুল মিয়া বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে ১০ মার্চ চকবাজার থানায় খুনের মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, অজ্ঞাত খুনিরা সিজানকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দক্ষিণ পাশে বাশার ভিলার সামনে কুপিয়ে জখম করে হত্যা করেছে।

মামলাটি প্রথমে তদন্ত করছিল চকবাজার থানা। পরে সিজান হত্যার তদন্তভার পায় পিবিআই। ১১ মার্চ অভিযান চালিয়ে কক্সবাজার থেকে মামলার প্রধান আসামি ইমনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর মুন্না মিয়াকে বংশালের নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই।

খুনের পর নৃশংস উল্লাস
তদন্ত কর্মকর্তা আল আমিন জানান, সিজানকে রাত ১১ টা ৪০ মিনিটের দিকে কোপায় সন্দেহভাজন খুনিরা। তিনি বলেন, ‘সিজানকে খুন করার পর আসামিরা একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। পুঁটলা সিফাতের বাসায় চলে যায় তারা। সেখানেই ভোর ছয়টা পর্যন্ত তারা একসঙ্গে ছিল। পুঁটলা সিফাতের বাসা বেশ বড়সড়। সাউন্ড বক্সে কুখ্যাত খুনি এরশাদ শিকদারের গান ছেড়ে দিয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছিল তারা। ওই উল্লাস করার রেকর্ডিং পাওয়া গেছে। উল্লাস করার সময় খুনিরা ইমন গ্রুপের আরেক সদস্য রিফাত হোসেনকে ফোন দিয়েছিল। তাঁর ফোনে সবকিছু অটো রেকর্ড হয়েছিল।’

পিবিআই কর্মকর্তা আল আমিন বলেন, ‘সিজানকে খুন করার পর এরশাদ শিকদারের গান ছেড়ে সন্দেহভাজন খুনিরা যেসব কথা বলেছে, তা বীভৎস।’

চকবাজার-বংশালে আট গ্রুপ
পুলিশ বলছে, মাস দেড়েক আগে ফুটবল খেলা নিয়ে দ্বন্দ্বের শুরু হয়। ইমনের গ্রুপের পুঁটলা সিফাতকে হোসেন গ্রুপের লোকজন ছুরিকাঘাত করে। ইমন গ্রুপের লোকজন দলনেতা হোসেনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু এই পরিকল্পনার কথা জেনে ফেলে সিজান। পরে সে তা হোসেন গ্রুপকে জানিয়ে দেয়। পরে সিজানকে হত্যার পরিকল্পনা করে ইমন। এর অংশ হিসেবে সিজানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে ইমন।

আদালতকে পিবিআই প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, বংশাল ও চকবাজার থানা এলাকার সুরিটোলা, চানখাঁরপুল ও মালিটোলা এলাকায় একাধিক সিনিয়র-জুনিয়র গ্রুপ আছে। একটি ইমন গ্রুপ-সমর্থিত, আরেকটি সিজান গ্রুপ-সমর্থিত। এলাকায় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে গ্রুপ দুটির মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল।

সিজান তার মামা শাওন হোসেনের গ্রিলের দোকানে কাজ করত। শাওন হোসেনবলেন, ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে ইমনের গ্রুপের সঙ্গে তাঁর ভাগনে সিজানের কিছু গন্ডগোল হয়েছিল বলে তিনি জানতেন। সিজানেরও একটা গ্রুপ ছিল। কিন্তু সিজানের পরিবার এসব বিষয়ে কিছুই জানত না।

পিবিআইয়ের আল আমিন শেখ বলেন, চকবাজার ও বংশাল এলাকায় অন্তত সাত থেকে আটটি গ্রুপ আছে। প্রতিটি গ্রুপের সদস্য আছে ৩০ থেকে ৪০ জন। এরা এলাকার বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। সিজান হত্যাকাণ্ডে জড়িত পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে।

সিজানের বাবা মুকুল মিয়া ভাঙারি ব্যবসা করেন। মা নাসরিন বেগম গৃহিণী। নাসরিন বেগম বলেন, তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। সিজান তাঁর একমাত্র ছেলে। ছেলে খুনের সঙ্গে জড়িত সবার ফাঁসি চান নাসরিন।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর