সমীক্ষা ছাড়াই রুট পারমিট, সড়ক দুর্ঘটনা থামছে না

রাজধানীর মিরপুর, আগারগাঁও হয়ে গুলিস্তান ও যাত্রাবাড়ী গন্তব্যে চলছে প্রায় ২০টি কোম্পানির এক হাজারের বেশি বাস-মিনিবাস। এসব কোম্পানির নামে আরও কয়েকশ’ বাস ও মিনিবাস নামানোর অনুমতি আছে। অথচ সড়কের ধারণক্ষমতা বা যাত্রী সংখ্যার অনুপাতে কী পরিমাণ বাস বা মিনিবাস দরকার- এ ধরনের কোনো সমীক্ষা নেই। সরকার বা বাস মালিক কারও কাছে নেই এ সংক্রান্ত তথ্য।

এ অবস্থায় সম্প্রতি রুটগুলোতে একাধিক কোম্পানির আরও শতাধিক বাস ও মিনিবাস নামানোর অনুমোদন দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি (আরটিসি)। এতে সড়কের ধারণক্ষমতার তুলনায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। বাসগুলো যাত্রী ধরতে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় নেমে মানুষ মারছে। শুধু মিরপুর নয়, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, সাভারসহ কয়েকটি রুটেও প্রায় অভিন্ন চিত্র রয়েছে।

জানা গেছে, সড়কে নৈরাজ্যের অন্যতম কারণ সমীক্ষা ছাড়াই রুট পারমিট দেয়া, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, চালকের মাদকাসক্তি ও অদক্ষ চালক, আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাব ইত্যাদি। এসব বন্ধে নেই তেমন কার্যকর উদ্যোগ।

ফলে দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ২০১৮ সালে সারা দেশে ৩ হাজার ৫১৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৭৬ জন মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৭১৫ জন। চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত সড়কে ২৫৯ প্রাণ ঝরেছে।

সমীক্ষা ছাড়াই বাসের রুট পারমিট দেয়া সড়ক নৈরাজ্যের অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিডেন্ট রিচার্স ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. শামসুল হক। তিনি বলেন, সমীক্ষা ছাড়া রুট পারমিট দেয়ায় সব উদ্যোগ শুরুতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই বাসের রুট পারমিট দেয়ার পর যত উদ্যোগ নেয়া হোক না কেন, নৈরাজ্য বন্ধ হবে না।

আমরা সবসময় বলে আসছি, ঢাকাকে কয়েকটি রুটে ভাগ করে বড় উদ্যোক্তাদের রুট পারমিট দিতে হবে। তাহলে ওই সব উদ্যোক্তা তাদের বিনিয়োগ বাঁচাতে সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষা করবেন। তারাই চালকদের প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য সুবিধা দেবেন। কোনো যোগ্যতা ছাড়াই রুট পারমিট পাওয়ায় রাস্তায় নেমে প্রতিযোগিতা শুরু হয়, এতে বাড়ছে দুর্ঘটনা।

বিআরটিএর সচিব মো. আবদুস সাত্তার বলেন, সড়কে নৈরাজ্য ঠেকাতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছেন। অন্যান্য জেলায় ডিসি ও ইউএনওরা অপারেশন চালাচ্ছেন।

পাশাপাশি সড়ক নিরাপত্তায় অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করছি। ফিটনেসহীন গাড়ি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিবছর যখন ফিটনেস নিতে আসে তখন আমরা ভালোভাবে পরীক্ষা করি। এরপরও চলাচল করলে মোবাইল কোর্ট ওই গাড়ি ডাম্পিং বা জরিমানা করেন। আর লাইসেন্সবিহীন চালককে পেলে সাজা দেয়া হয়।

বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, দেশে ৩৮ লাখের বেশি গাড়ি আছে। অপরদিকে লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ২৪ লাখের কিছু বেশি। অনেক গাড়ির অস্তিত্ব না থাকার পরও বর্তমানে ১০ লাখের বেশি লাইসেন্সবিহীন চালক রয়েছেন। তাদের অদক্ষ পরিচালনার কারণেও সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভায় এ বিষয়টি উঠে আসে। ওই সভায় ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বিষয়টি স্বীকার করে মাদকাসক্তদের হাতে গাড়ি তুলে না দিতে মালিকদের অনুরোধ জানান।

ঢাকা আরসিটির হিসাব অনুযায়ী, রাজধানী ও আশপাশে ৩৬৬টি রুটে গাড়ি চলাচলের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসব রুটে প্রায় চারশ’ কোম্পানি রয়েছে। কোম্পানিগুলোর আওতায় ১৬ হাজার ৬০৩টি গাড়ি চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়েছে। গাড়ি নেমেছে ৯ হাজার ৪৭টি। এর মধ্যে বাস ৬ হাজার ৩৮২টি ও মিনিবাস ২ হাজার ৬৬৫টি। এসব গাড়ির মালিকের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। একই কোম্পানিতে যেমন অনেকের গাড়ি রয়েছে, তেমনি কয়েকটি গাড়ির মালিক একই ব্যক্তি- সেই চিত্রও রয়েছে।

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই একই রুটে অনেক কোম্পানির বাসের রুট পারমিট দেয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ কোম্পানির মালিক প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।

এ ছাড়া একই কোম্পানিতে অনেক মালিকের গাড়ি থাকায় বেশি আয়ের আশায় সড়কে গণপরিবহনের রেষারেষি বাড়ছে। যাত্রী বেশি পাওয়া এবং দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে আরেকটি ট্রিপের সিরিয়ালের আশায় নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না চালকরা। তারা রাস্তার মাঝখানে গাড়ি রেখে যাত্রী ওঠানামা করছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও হিমশিম খেতে হয়।

সমীক্ষা ছাড়া গাড়ির রুট পারমিট দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন আরটিসির সদস্য সচিব বিআরটিএর উপ-পরিচালক মো. শফিকুজ্জামান ভূঁইয়া। তিনি বলেন, কোন রুটে গাড়ি চলবে, কতটির অনুমোদন দেয়া হবে- সেই এখতিয়ার কমিটির। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি বৈঠক করে গাড়ির রুট পারমিট ও সিলিং অনুমোদন দেন। তিনি জানান, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ট্যাক্সি ক্যাব অনুমোদনের ক্ষমতা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের হাতে। আর কতটি গণপরিবহন চলবে, তা নির্ধারণ করে আরটিসি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আরটিসির সভাপতি। এ কমিটির ৫-৬ জন সদস্য হচ্ছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতা। এ ছাড়া বিআরটিএ, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক ও ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা এর সদস্য। তবে রুট পারমিট দেয়ার ক্ষেত্রে পরিবহন নেতাদের জোরালো ভূমিকা থাকে।

জানা গেছে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাস মালিক বলেন, নিয়ম অনুযায়ী রুট পারমিট পেতে হলে কোনো-না-কোনো কোম্পানির সদস্য হতে হবে। আমার বাসের রুট পারমিটের জন্য টাকা দিয়ে একটি কোম্পানির সদস্য হয়েছি। এখন ওই কোম্পানিকে চাঁদা দিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন টার্মিনাল ও শ্রমিক সমিতিকেও চাঁদা দিতে হয়। এরপর গাড়ির জ্বালানি, মেরামত ও শ্রমিক খরচ বাদে যে আয় হয় সেটাই আমরা পাই।

তিনি বলেন, অনেক কোম্পানি ও সমিতি তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে গাড়ির চালক হিসেবে রাখতে বাধ্য করে। চাঁদা আদায়কারী এসব সংগঠনের প্রশ্রয়ের কারণে চালকরা বেপরোয়া আচরণ করে। তারা অনেক সময় মালিকের কথাও মানে না।

বুয়েটের এআরআইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে সারা দেশে ৩ হাজার ৫১৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৭৬ জন মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন ৮ হাজার ৭১৫ জন। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় সর্বোচ্চ ২৯৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনার জন্য বাস ২৩, ট্রাক ২২, মোটরসাইকেল ১৯ শতাংশ দায়ী। বাকি দুর্ঘটনার জন্য অন্যান্য যানবাহন দায়ী। এতে আরও বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার ৩৪ ভাগই ঘটে সামনে থেকে ধাক্কা দিয়ে মানুষ মেরে ফেলা। আর ২২ ভাগ ঘটে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ার কারণে। ১৫ ভাগ ঘটে নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণে। বাকিটা অন্যান্য কারণে।

আরটিসির নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মিরপুর থেকে আগারগাঁও হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত অন্তত ১৪টির বেশি কোম্পানিকে সাড়ে ৯শ’ গাড়ি চলাচলের অনুমতি দেয়া আছে। কোনো কোম্পানির গন্তব্য মিরপুর থেকে গুলিস্তান, কারও গন্তব্য গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট, কারও গন্তব্য মতিঝিল, কমলাপুর, ডেমরা, সাইনবোর্ড ও সদরঘাট। অথচ এসব কোম্পানির বাসই মিরপুর-১০, ফার্মগেট হয়ে গুলিস্তান পর্যন্ত চলাচল করে।

এরপরই গন্তব্য ভিন্ন হয়ে যায়। এ ছাড়া ভিন্ন বাস স্টপেজ উল্লেখ করে আরও কয়েকটি কোম্পানির বাস চলাচল করছে। এরপরও মিরপুর সার্ভিস নামে একটি কোম্পানিকে ২০টি, কেয়ার পরিবহনকে ৪০টি ও আল জাজিরা নামে আরেকটি কোম্পানিকে ৩০টি বাস নামানোর রুট পারমিট দেয়া হয়েছে। একইভাবে মিরপুর-১ থেকে শ্যামলী হয়ে কলেজগেট রুটেও অন্তত ২৫টি কোম্পানির এক হাজারের বেশি বাস চলাচল করছে। এ ছাড়া উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, সাভার থেকেও একই রুটে অনেক কোম্পানির হাজার হাজার বাস চলাচল করছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সড়কে নৈরাজ্যের আরেক বড় কারণ হচ্ছে আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাব। চালকরা অনিয়ম করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু সদস্যদের প্রশ্রয়ে এসব চালক পার পেয়ে যায়। তারা বলেন, সম্প্রতি প্রগতি সরণিতে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে সু-প্রভাত কোম্পানির ১৬৬টি গাড়ি চলাচলের ওপর সাময়িক স্থগিতাদেশ আরোপ করেছে বিআরটিএ।

এ দুর্ঘটনার কারণে ওই গাড়ি ও চালক গ্রেফতরা করা হয়েছে। এখন বিচার শুরু হবে। এ অবস্থায় বাস মালিক-শ্রমিকরা ওই চালককে বাঁচাতে ভোগান্তি তৈরির মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে চাপে ফেলার কৌশল নিয়েছে। যেসব গাড়ির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি সেগুলোও রাস্তায় বাসের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। যাতে জনগণ দুর্ভোগের শিকার হন, বাস মালিক চালকদের পক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য হন, সে কারণে তারা এ কাজ করছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর