আশিকের ভিন্ন উদ্যোগ!

খুলনা অঞ্চলের মুন্ডা শিশুদের জন্য স্কুল, বাঘ বিধবা নারীদের জন্য দর্জি প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজ করে আসছেন আশিকুজ্জামান আশিক এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বার্তা বাজার এর সাথে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বার্তা বাজারের নিজস্ব প্রতিবেদক- আকরাম হোসেন নাঈম

নিজ উদ্যোগে মুন্ডা শিশুদের জন্য স্কুল,বাঘ বিধবা নারীদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং সেলাইমেশিন,
শিক্ষার্থীর বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের কাজ। বিভিন্ন সমাজসেবী কাজ করে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য অনার্স মাস্টার্স শেষ করা শিক্ষার্থী আশিকুজ্জামান আশিক। আশিকের বাড়ি খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবন কোল ঘেঁষা এলাকায় । নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট আইসিডি) নামের একটি সংগঠন।

কয়রার সুন্দরবন তীরবর্তী এলাকার বিভিন্ন বয়সের শতাধিক তরুণ তরুণী ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার তার সংগঠনের সদস্য হিসেবে কাজ করছে। এ পর্যন্ত ৪০ জন বাঘ বিধবাকে ১ মাসের দর্জি প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মাঝে সেলাইমেশিন ও সিটকাপড় বিতরণ করেছে। কয়রার সুন্দরবনের তীর ঘেঁসে বসবাসরত আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়ের ১০ জন নারীকে পুঁতি শিল্পের প্রশিক্ষণের কাজ চলছে। মুন্ডা সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা সহায়তা উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেছে” বিরসা মুন্ডা প্রভাতী স্কুল”। সম্পন্ন করেছে ৩ হাজার স্কুল শিক্ষার্থীর বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের কাজ।

সুন্দরবনে মাছ, মধু ও কাঠি সংগ্রহ করতে যেয়ে যেসকল জেলে, বাওয়ালী ও মৌয়াল বাঘের আক্রমণে নিহত হয়েছেন তাদের স্ত্রীরা দীর্ঘদিন ধরে ছেলেমেয়েদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে আসছে। স্ত্রীদের কারণে তাদের স্বামীকে বাঘে খেয়েছে এমন কুসংস্কার আর অপবাদ মাথায় দিনাতিপাত করা বাঘ বিধবাদের মুখে হাসি ফুটতে শুরু করেছে। বাঘ বিধবাদের দুঃখ দুর্দশার কথা চিন্তা করে তাদের পাশে দাড়িয়েছে আশিক।

ছোট বেলা থেকে আশিক বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর তার সামাজিক কর্মকান্ড আরো গতিশীল হয়। খুলনার কয়রা উপজেলায় বিশ্বিবদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু এমন অনেক মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে কোচিং ও ভর্তি নির্দেশিকা বই গাইড বিনামূল্যে বিতরণ করে আসছে। বর্তমানে বাঘ এতিম, এতিম, প্রতিবন্ধী ও মুন্ডা শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেছে।

আইসিডির প্রতিষ্ঠাতা আশিকুজ্জামান বলেন, “প্রথম দিকে আমি বাঘ বিধবাদের জন্য কিছু করার তাগিদে প্রতিষ্ঠা করি ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট (আইসিডি)। টিউশনির টাকা থেকে একটা অংশ ব্যয় করি আইসিডি সংগঠনে। ছোট পরিসরে চলতে থাকে শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নমূলক নানা কর্মকান্ড।

প্রাথমিকভাবে ১০ জন বাঘ বিধবাকে সেলাই মেশিন দেয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া পড়ে। আমার এই কাজে এগিয়ে আসে “এলজি ইলেকট্রনিকস বাংলাদেশ”৷ এলজির কান্ট্রি ডিরেক্টর ডি কে সন বাঘ বিধবাদের কল্যাণে কাজ করার জন্য ৪ লাখ টাকার নগদ চেক প্রদান করেন। আমি সেই অর্থ দিয়ে আরো ৩০ জন বাঘ বিধবাকে মাসব্যাপী দর্জি প্রশিক্ষণ শেষে তাদের মাঝে সেলাই মেশিন,সিট কাপড় ও প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রদান করি। শুধু তাই আরো তিনজন বাঘ বিধবা চালের কুঁড়ার ব্যবসা ও গরু পালন করে স্বাবলম্বী হচ্ছে আমাদের সহযোগিতায়।

এর মধ্যে এগিয়ে আসে প্রাণ আরএফএল গ্রুপ৷ তাদের সহযোগিতায় উপকূলের ৩ হাজার স্কুল শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ সম্পন্ন করেছি। বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থা “স্বপ্ন পাড়ি’র সহযোগিতায় শতাধিক মুন্ডা শিক্ষার্থী, বাঘ এতিম, এতিম, প্রতিবন্ধীর মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে।

কয়রার এই অঞ্চলে বসবাসরত মুন্ডা সম্প্রদায়ের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিরসা মুন্ডা প্রভাতী স্কুল। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মুন্ডা সম্প্রদায়ের স্বপ্ন পুরুষ বিরসা মুন্ডার স্বরণে স্কুলের নামকরণ করা হয়েছে। মুন্ডা শিশুরা যাতে ছোটবেলা থেকে তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য জানতে পারে এবং পড়ালেখা শিখতে পারে সে জন্য এই স্কুল। অভাব অনাটনে থাকা মুন্ডা নারী পুরুষ দিনরাত পরিশ্রম করে জীবিকা উপার্জন করে।

এ সম্প্রদায়ের অধিকাংশ বাবা মা নিরক্ষর হওয়ায় তাদের শিশুদের অক্ষর জ্ঞান ও পড়ালেখায় হাতেখড়ি দেয়ার গুরুত্ব তারা অনুধাবন করতে পারেনা বলে সঠিক গাইড লাইনের অভাবে তারা সবার সাথে খাপ খাইয়ে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেনা। আমাদের স্কুলে একজন স্কুল পড়ুয়া মুন্ডা নারীর তত্ত্বাবধানে তারা অতি যত্নে পড়ালেখা শিখবে। দেশের ইতিহাস জানার পাশাপাশি তারা মুন্ডাদের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে। স্কুলের প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ দেয়া হয়েছে ।

স্কুলের আপাতত কোন অবকাঠামো না থাকায় মুন্ডা সম্প্রদায়ের এক বাড়িতে স্কুলের জন্য নির্ধারিত স্থানে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। মাসিক এক হাজার টাকার বেতনে নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষিকা বাসন্তী মুন্ডার শিক্ষকতায় প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে ৯ টা পর্যন্ত স্কুলের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।

এ ছাড়া ঈদের সময় অসহায় হতদরিদ্র, এতিম শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি মুন্ডা সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝেও ঈদের পোষাক ও ঈদ সামগ্রী বিতরণ করে আমরা ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিই।

নানান চড়াই উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়া আশিক বলেন, বাঘবিধবাদের জন্য কাজ করার ফলে ব্যাপক সাড়া পড়ায় সুন্দরবন তীরবর্তী উপকূলীয় কয়েকটি উপজেলা থেকে বাঘ বিধবারা সাহায্যের জন্য ফোন করতে শুরু করেছে। সক্ষমতা না থাকায় তাদের সাহায্য করতে পারছেন না। তবে তাদের আশ্বস্ত করে যাচ্ছেন ভবিষ্যতে কোন সুযোগ আসলে তাদের পাশে দাঁড়াবেন।

আশিক আরো বলেন, আমরা শুধু কয়রা উপজেলায় একটি তালিকা করেছে যেখানে বাঘ বিধবা রয়েছেনে ২ শতাধিক। প্রতিদিন কোন না কোন বাঘ বিধবা বাড়িতে আসছেন বা ফোন করছেন যেন তাদের জন্য কিছু করা হয়।

সুন্দরবন তীরবর্তী উপজেলা কয়রা, শ্যামনগর, রামপা, মোড়লগঞ্জ ও দাকোপে অনেক বাঘ বিধবা রয়েছে বলে জানতে পেরেছি, বলে জানান আশিক। তিনি সুযোগ পেলে এসব এলাকার বাঘবিধবাদের কল্যাণে কাজ অব্যাহত রাখবেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মুন্ডা স্কুল শিক্ষিকার বেতন ও স্কুল পরিচালনা ব্যয় বহন করছে টিউশনির টাকা থেকে। স্কুলের জন্য জায়গা নির্ধারিত থাকলেও অর্থের কোন অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারছেনা আশিক।

সুন্দরবনে দস্যুতা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা মানুষদের পাশে দাড়ানোর উদ্যোগের কথাও জানিয়েছেন আইসিডির প্রতিষ্ঠাতা। শুধু তাই নয় তার নেতৃত্বে দীর্ঘদিন কয়রায় সুন্দরবনকে ঘিরে একটি পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণের সামাজিক আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে খুলনা জেলা প্রশাসন ও কয়রা উপজেলা প্রশাসন সে উদ্যোগে সাড়া দিয়ে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

সুন্দরবন উপকূলের নানান উন্নয়নের স্বপ্ন দেখা ঢাবি শিক্ষার্থী আশিক আজীবন মানুষের সেবায় কাজ করে যেতে চান।

আশিক,সেলিম,মুজাহিদ, মোজাম্মেল হক, ফরহাদ,আব্দুল্লাহ, হায়দার, আমিরুল , আহসানুল্লাহ, বাসন্তী মুন্ডা সহ অসংখ্য তরুণ তরুণী আইসিডির সদস্য হয়ে উপকূলের উন্নয়নে কাজ করছে।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর