দুজনের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

সম্প্রতি দুটি বিষয় বাংলাদেশের মানুষকে বেশ নাড়িয়ে তুলেছে।বিবিকের তাড়নায় যে যার জায়গা থেকে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে।আর তা দুজন নারীকে নিয়ে।একজনের নাম নুসরাত জাহান রাফি। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে লড়াই করে ঘাতকের দেয়া আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।নুসরাতের নির্মম মৃত্যু স্থবির করে দিয়েছে জাতীর বিবেককে।হয়ত দূর থেকে চোখের পানি নিরবে মুছেছে ঘাতকরাও।সর্বশেষ বুধবার (১৭ জুলাই)যখন এইচএসসির ফলাফল দেয়া হয় তখন ফের আলোচনায় বগুড়ার সেই মেয়েটি।এই মাদ্রাসা ছাত্রী আলীম পরীক্ষার মাত্র দুটি বিষয় পরীক্ষা দিয়েছে।সে বিষয় (কোরআন মাজীদ ও হাদীস) ‘এ’ পেয়েছে।দ্বিতীয় পরীক্ষার দিন ঘাতকের দেয়া আগুনে শেষ হলো নুসরাতের দুনিয়াবি যত পরীক্ষা।এজন্যই বাকি সব বিষয়ে এসেছে ‘এফ’! এমন ফলাফল দেখে নিজেদের ধরে রাখতে পারেনি সহপাঠিরা।কান্নায় ভেঙে পড়েছে সবাই।

নুসরাতের পরীক্ষার মার্কশিট

অপরজন আয়েশা সিদ্দিকী মিন্নি।তিনি মারা যাননি কোন ঘাতকের দেয়া আগুনে।তবে বেশ সমালোচিত হয়েছেন অন্য এক কারণে।পাঠক, সেটা আপনাদের সকলের কম-বেশি জানা।বিচারাধীন থাকায় এবিষয়ে কিছু বলতে পারলাম না।তবে এতটুকু বলতে পারি স্বামী হত্যা মামলার ১ নম্বর সাক্ষী তার স্ত্রী। সর্বশেষ আদালতের মাধ্যমে তাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

যদিও বিচার শেষ হওয়ার আগে অপরাধী বলা যাবে না তাকে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ রাখলে মিন্নির জড়িত থাকার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া যায় না।বলা যায়, সন্ত্রাসীর সঙ্গে মিন্নির সম্পর্ক ছিলো নিবিড়।তা না হলে তো একজন নিরপরাধ ব্যক্তি এবং মামলার এক নম্বর সাক্ষীকে রিমান্ডে নেয়ার কথা নয়।যা হোক বলা যেতে পারে, নুসরাত নারী জাতির অহংকার আর মিন্নির বিষয়টা আপনাদের হাতে ছেড়ে দিলাম।

রিফাত হত্যার মাত্র দুই মাস আগে গত ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুসরাত জাহান রাফি নামের এক মাদ্রসা ছাত্রী। তার আগে ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় আলিম পরীক্ষা কেন্দ্রে গেলে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।

ঘটনার পর থেকেই সামাজিক মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে তুমুল ঝড় ওঠে। হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে জেগে ওঠে বিবেক। দেশজুড়ে সভা-সমাবেশ, মিছিল-মানববন্ধনের প্রেক্ষিতে স্বল্প সময়ের মধ্যে গ্রেফতার হন আওয়ামী লীগ নেতা, অধ্যক্ষ, ওসিসহ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা। যৌন হয়রানির প্রতিবাদকারী নুসরাত হয়ে উঠেন নারীদের আদর্শ।যার জন্য রাস্তায় নেমে এসেছেন সমাজের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলোও।


নুসরােত হত্যার বিচারের দাবিতে রাস্তায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো

নুসরাতের হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে দেশের আনাচে-কানাচে সব জায়গায় রাস্তায় নেমেছে সচেতন ব্যক্তিরা।নুসরাতের জন্য শুধু নারীরা নয় রাস্তায় নেমেছে দলবল নির্বিশেষে সর্বোস্তরের সাধারণ মানুষ।

নুতরাত হত্যার বিচারের দাবিতে মানুষের ঢল

অন্যদিকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টারত আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি শুরুতে মানুষের মনে আদর্শ স্ত্রী হিসেবে স্থান করে নিলেও ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল।

ফেসবুক স্ট্যাটাস, হত্যাকারীর সঙ্গে জন্মদিন পালনের ভিডিও, হত্যাকাণ্ডে আগমুহুর্তে স্বামীর সঙ্গে না যাওয়া, নয়ন বন্ডের সঙ্গে বিয়ে, রিফাতের সঙ্গে বিয়ের পরও নয়নের বাসায় যাওয়া ইত্যাদির কারণে সন্দেহ দেখা দেয় মানুষের মনে।

আর এহেন কাণ্ড দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে যার মতো করে মন্তব্য করছেন।যেখানে নুসরাতের হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য মানববন্ধন হয়েছে, সংবাদ সম্মেলন হয়েছে, সেখানে মিন্নিকে (মামলার সাক্ষী) গ্রেফতারের জন্য বানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন হয়েছে!অনেকের ধারণা যার প্রেক্ষাপটে মিন্নিকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয় পুলিশ।

মিন্নিকে গ্রেফতারের দাবিতে মানববন্ধন

নুরাতকে নিয়ে সাধারণ মানুষের যে আবেগ কাজ করেছে, মিন্নির ক্ষেত্রে ঘটেছে তার উলোট।তাহলে কেন এমনটা? সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ বুলালেই যেটা চোখের সামনে আটকে পড়ে।

সামাজিক মাধ্যমে মিন্নি সম্পর্কে এরকম হাজারো নেতিবাচক মন্তব্য আছে

এদিকে বুধবার (১৭ জুলাই) আদালতে উঠানো হয় তিন্নিকে।সে দিন কোনো উকিল মিন্নির হয়ে কথা বলতেও নারাজ।শেষমেষ বিচারক কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মিন্নিকে উদ্দেশ্য করে জানতে চান তার কোনো বক্তব্য আছে কিনা? মিন্নি এ সময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, স্যার আমি এই ঘটনার সাথে জড়িত নই, ওই দিন যে এই ঘটনা ঘটবে তা আমি জানতাম না।

তদন্তকারী কর্মকর্তার বক্তব্য শেষে মিন্নি আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, বিভিন্ন সময় আসামিরা তাকে ফোনে বিরক্ত করতো ও ভয় ভীতি দেখাতো। এমনকি প্রাণনাশের হুমকিও দিতো। তিনি আরও বলেন, ‘আমি বা আমার পরিবার আসামিদের ভয়ে কোথাও মুখ খুলতে পারিনি। আমার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যাকারীদের বিচার চাই। আমাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মামলায় জড়ানো হয়েছে। বক্তব্যের একপর্যায়ে বিচারক হত্যাকারীর কল লিস্টে তার নম্বর কিভাবে এলো জানতে চাইলে মিন্নি নিরব থাকেন।

রিফাত শরীফ হত্যা মামলার এক নম্বর আসামীকে সঙ্গে সঙ্গে না মারলে হয়ত আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলত।ফলে পানি আর এত দূর গড়াতো না।

বিচারে শেষে যদি মিন্নি দোষী প্রমানিত হন তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি হবেন নারী জাতির কলঙ্ক। তবে এতে নারী সমাজের অপমানিত বা লজ্জিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা যে সমাজে মিন্নিরা আছেন, নুসরাতরাও সেই সমাজেই বসবাস করেন।মানুষ আর অপরাধীর আকৃতিতে কোন পরিবর্তন নেই।দুজনের গঠন চলনবলন একই হয়ে থাকে।

লেখক ও সাংবাদিক

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর