কি ভাবে আবজাল-রুবিনা দম্পতি বিদেশে পালিয়ে গেলে !

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দুর্নীতির অভিযোগে কুখ্যাতি লাভ করা মেডিকেল এডুকেশন শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমের ‘খোঁজ পাচ্ছে না’ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়েই সপরিবারে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তবে আবজালের তিনটি পাসপোর্ট ‘ব্লক থাকার’ পরও তিনি কীভাবে পালালেন সে বিষয়ে সদুত্তর পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে দুদক কর্মকর্তারা বলেছেন, জরুরি ভিত্তিতে আবজালের বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে তথ্য চেয়ে গত ১৩ মার্চ ইমিগ্রেশন কর্র্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চিঠির জবাব দেয়নি তারা। চিঠি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন শাখার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের কাছে যেসব পাসপোর্টের তথ্য দেওয়া হয়েছে সেগুলোর বিবরণ অনুযায়ী আবজাল দম্পতি দেশেই আছেন।

আবজাল দম্পতি কোথায় আছেন জানতে চাইলে দুদকের পরিচালক কাজী শফিকুল আলম বলেন, ‘আবজাল হোসেনের তিনটি পাসপোর্ট ও তার স্ত্রীর পাসপোর্টের তথ্য দিয়ে দুদকের পক্ষ থেকে ৬ জানুয়ারি ইমিগ্রেশন কর্র্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে তাদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার কথা জানানো হয়েছে। এর পর থেকে পাসপোর্ট ব্লক থাকায় তার বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই। এরপরও আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে তার বিদেশে আত্মগোপনের তথ্য পেয়েছি। অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে খোঁজখবর নিতে বলা হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৩ মার্চ তিনি বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন কর্র্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন। শনিবার বিকেল পর্যন্ত ইমিগ্রেশন কর্র্তৃপক্ষ কোনো জবাব দেয়নি।’

দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার পদ থেকে গত ১৪ জানুয়ারি সাময়িক বরখাস্ত করা হয় আবজালকে। তার স্ত্রী রুবিনা খানম ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার স্টেনোগ্রাফার। ২০০০ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেন। দুদকের তথ্য অনুযায়ী, আবজাল বেতন-ভাতা পেতেন সব মিলিয়ে ৩০ হাজার টাকা। অথচ তাদের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ আছে। ঢাকার উত্তরায় এই দম্পতির পাঁচটি বাড়ি, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে একটি বাড়ি, দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২৪টি প্লট ও ফ্ল্যাট আছে। এর বাইরে দেশে-বিদেশে আছে বাড়ি-মার্কেটসহ অনেক সম্পদ। এই দম্পতির এত সম্পদ থাকার অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। গত ১০ জানুয়ারি আবজালকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। রুবিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৭ জানুয়ারি হাজির হতে বলা হলে তিনি সময় চেয়ে আবেদন করেন।

আবজাল পরিবারকে খুঁজে না পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে জিজ্ঞাসাবাদ দলের সদস্য ও সাবেক অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক শামসুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আবজালের সপরিবারে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তার পাসপোর্ট ব্লক করা আছে। আমরা শুনেছি তিনি বিদেশে আছেন। এ বিষয়ে জানার জন্য ইমিগ্রেশন কর্র্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘গত জানুয়ারিতে আবজাল দম্পতির বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত দুদকের চিঠি পেয়েছি এবং সে অনুযায়ী তার পাসপোর্ট ব্লক করে রাখা হয়েছে। পরে দুদক থেকে তার বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে জানতে চেয়ে আরেকটি চিঠি দিয়েছে দুদক। আমাদের কাছে যে পাসপোর্ট আছে সে অনুযায়ী আবজাল দম্পতি দেশেই আছেন। তাদের বিদেশে পালানোর কোনো সুযোগ নেই।’ অন্য কোনো পাসপোর্ট বা জাল পাসপোর্টে বিদেশ যাওয়া সম্ভব নয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে থাকা তথ্য বলছে, আবজাল সপরিবারে দেশেই আছেন।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিজস্ব গোয়েন্দা সূত্রে দুদক জানতে পেরেছে, আবজাল সপরিবারে লাপাত্তা হওয়ার আগে দুদকেরই সদ্যবিদায়ী মহাপরিচালক (প্রশাসন ও এনফোর্সমেন্ট) মুহাম্মদ মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেন। আবজালের সঙ্গে তার কথা বলার প্রমাণও মিলেছে। অভিযোগ রয়েছে, বিদায়ী মহাপরিচালক আবজাল দম্পতিকে বিশেষ সুবিধা দেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুনীর চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, তিনি কিছুদিন ওই শাখার দায়িত্বে ছিলেন। পরে এই দায়িত্ব থেকে সরে আসেন। সর্বশেষ তিনি সম্পত্তি ক্রোকসহ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছেন। তার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অভিযোগ উঠেছে, আবজাল-রুবিনা দম্পতির সম্পদের অনুসন্ধানে অনেক দিন ধরেই কাজ করছে দুদক। তারা চাইলে এই দম্পতিকে দুদক আইনে গ্রেপ্তার করতে পারত। কিন্তু দুদক তা করেনি। আবজাল-রুবিনা দম্পতিকে কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, আবজাল-রুবিনা দম্পতির অনুসন্ধানটি ছিল অবৈধ সম্পদ অর্জন-সংক্রান্ত। এ ধরনের অভিযোগ অনুসন্ধানকালে গ্রেপ্তারের সুযোগ নেই। তবে দুদকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উপপরিচালক দেশ রূপান্তরকে জানান, অবৈধ সম্পদ অর্জন-সংক্রান্ত অভিযোগ অনুসন্ধানকালেও আসামিকে গ্রেপ্তার করা যায়। দুদক আইনে সেটা বলা আছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আবজাল-রুবিনা দম্পতি বিদেশে পালিয়ে গেলে বা দেশে আত্মগোপন করে থাকলে অবশ্যই দুদকের গাফিলতি রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে দায় শুধু দুদকের একার নয়। দুদকের অবশ্যই দেখা দরকার তাদের কোনো গাফিলতি ছিল কিনা। তারা ইমিগ্রেশন কর্র্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছিল। তাই এক্ষেত্রে ইমিগ্রেশন কর্র্তৃপক্ষেরও দায়দায়িত্ব রয়েছে।’ ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, আবজালের মতো একজন ব্যক্তির বিষয়ে দুদকের উচিত ছিল আরও নিবিড় পর্যবেক্ষণ থাকা। সেটা যথার্থভাবে দুদক করেছে কি না, অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না তা দুদককেই খতিয়ে দেখতে হবে। এখানে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের গাফিলতি রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। ‘এ ছাড়া এই দম্পতির পালিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে আরও কারা কারা দায়ী ছিল তাদেরকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি’, বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।

অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে আবজাল-রুবিনা দম্পতির হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগটি বর্তমানে অনুসন্ধান করছেন দুদকের উপপরিচালক তৌফিকুল ইসলাম। তিনি গত ১৩ মার্চ পুলিশের বিশেষ শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন) বরাবর চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে আবজাল ও তার স্ত্রীর পাসপোর্ট নম্বর, এনআইডি নম্বর দিয়ে তাদের বিদেশ যাওয়া-আসার তথ্য জানতে চাওয়া হয়। চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘গত ৬ জানুয়ারি এই দম্পতির বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তিনি যাতে বিদেশ যেতে না পারেন এজন্য দেশের সব বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও নৌবন্দরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জনশ্রুতি রয়েছে, তারা দেশ ছেড়ে গেছেন।’ এ বিষয়ে দ্রুত দুদককে তথ্য জানানোর অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে বা মার্চের প্রথম দিকে নিজেদের পাসপোর্ট ব্যবহার করেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সপরিবারে বিদেশ যান আবজাল। তারা বর্তমানে কোথায় আছেন সেই তথ্য নেই দুদকের হাতে। অবশ্য বিভিন্ন সূত্র বলছে, তারা অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমিয়েছেন।

গত ২২ জানুয়ারি দুদকের আবেদনে আবজাল-রুবিনার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক, অর্থাৎ, হস্তান্তর বা লেনদেন বন্ধ এবং ব্যাংক হিসাবগুলোর লেনদেন অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার আদেশ দেয় আদালত। আদালতের আদেশের পর তা গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ওই তথ্য প্রকাশিত হয়। তবে গত ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রুবিনা খানমের মালিকানাধীন রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল সচল ছিল। দুই সপ্তাহে ওই প্রতিষ্ঠানটিরসহ দম্পতির বিভিন্ন হিসাবে ৪৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আত্মগোপনে যাওয়ার আগে আবজাল দম্পতি থাকতেন উত্তরার তামান্না ভিলায়। গতকাল তামান্না ভিলায় খোঁজ নিতে গেলে কেয়ারটেকার মামুন শিকদার জানান, জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে বাসা ছেড়ে যান আবজাল দম্পতি। কোথায় গেছেন তা তার জানা নেই।

আবজাল দম্পতি তামান্না ভিলা ছেড়ে যাওয়ার প্রায় দেড় মাস পর গত ১৮ মার্চ বাড়ির মূল ফটকের পাশে একটি সাইনবোর্ড লাগানো হয়। এতে সম্পত্তির বিবরণ উল্লেখ করে বলা হয়, ‘ক্রোকাবদ্ধ উক্ত সম্পত্তি কোনোভাবে বা কোনো প্রকারে অন্যত্র হস্তান্তর, উক্ত সম্পত্তি সংক্রান্ত কোনো প্রকার লেনদেন বা উক্ত সম্পত্তিকে কোনোভাবে দায়মুক্ত করা আইনত নিষিদ্ধ।’ ওইদিন দুদক কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান, আবজাল দম্পতি কোথায় আছেন, সেটা তাদের জানা নেই।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর