পুলিশে চাকরি দিবে বলে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দাবি আ’লীগ নেতার!

দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছেলে ইমরান হোসেন। পরিবারের অভাব ঘোচাতে পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরির জন্য আবেদন করে। বিষয়টি জেনে একটি চক্র ইমরানের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। চক্রটি দাবি করে তারা প্রতিবছর ৮-১০ জনকে পুলিশে চাকরি দেয়।

৫ লাখ টাকা দিতে পারলে ইমরানেরও চাকরি হবে। সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও একমাত্র ছেলের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে টাকা দিতে রাজি হন ইমরানের মা-বাবা।

কিন্তু শারীরিক পরীক্ষা দিতে সিলেট পুলিশ লাইনে উপস্থিত হয়ে মাইকের ঘোষণা শুনে ইমরানের ধারণা ভেঙে যায়। জানতে পারে টাকা ছাড়াই চাকরি হয় পুলিশে। সে বাড়িতে গিয়ে হাসিমুখে বাবা-মাকেও বিষয়টি জানায়।

তারপরও ‘যদি চাকরি না হয়’- এই ভয়ে বা ছেলের ক্ষতি করতে পারে, এই ভেবে বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেননি বাবা জমির উদ্দিন (কানাইঘাট উপজেলার সাতবাক ইউনিয়নের জুলাই গ্রামের দিনমজুর)।

চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন তিনি। চাকরি হওয়ার পর চক্রটি টাকা নেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। বিভিন্নভাবে চাপ দিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত টাকা না পেয়ে ইমরানকে হত্যা ও চাকরি খাওয়ার হুমকি দেয়।

উপায় না পেয়ে শনিবার কানাইঘাট থানায় লিখিত অভিযোগ করেন ইমরানের মা আনোয়ারা বেগম। অভিযোগ পেয়ে কানাইঘাট থানা পুলিশ ৬ ঘণ্টার মধ্যে চক্রের এক সদস্যকে গ্রেফতার করে।

গ্রেফতারকৃত আলী আহমদ একই উপজেলার জয়পুর গ্রামের মৃত মকবুল আলীর ছেলে। সে নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা শ্রমিক লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য বলে পরিচয় দেয়। সাতবাক ইউনিয়ন পরিষদে উপনির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিল সে। চক্রের মূলহোতাদের বের করতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রোববার তাকে আদালতে হাজির করে ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আলী আহমদ চাকরি পাইয়ে দিতে ঘুষ দাবির কথা স্বীকার করেছে। সে জানায়, তারা প্রতিবছরই টাকার বিনিময়ে পুলিশে চাকরি দেয়। সে চাকরি প্রত্যাশীদের সঙ্গে চুক্তি করে আর জকিগঞ্জ উপজেলার সুলতানপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুস সাত্তার উপর মহলে তদবির করে। আলী আহমদ টাকা নিয়ে আবদুস সাত্তারের কাছে দেয়। সাত্তার কমিশন দেয়।

ইমরানের মা আনোয়ারা বেগম জানান, ইমরান পুলিশের চাকরির আবেদন করেছে জানার পর থেকেই যোগাযোগ রাখছে আলী আহমদ। ২৮ জুন জুমার নামাজের পর তাদের বাড়িতে এসে ৫ লাখ টাকায় চাকরি দেয়ার মৌখিক চুক্তি করে। ওইদিন সন্ধ্যায় ইমরানকে সাত্তারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় আলী আহমদ। সাত্তার ইমরানকে বলে তুমি আরও আগে আসলে না কেন? তোমাকে এসপির কাছে নিয়ে যেতাম। ওই সময় সাত্তার ইমরানকে চাকরির নিশ্চিয়তা দেয়।

৪ জুলাই মৌখিক পরীক্ষা (ভাইভা) শেষে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার সময় সিলেটের পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘আল্লাহর কসম, শতভাগ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে মেধার ভিত্তিতে নির্বাচিত করা হয়েছে। কোন ধরনের স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম করা হয়নি। কারও কোনো টাকা-পয়সা লাগেনি। কেউ কাউকে টাকা দেবেন না।’

পুলিশ সুপারের এমন বক্তব্য শুনে ধারণা পাল্টে যায় তাদের। তখনই অনুষ্ঠানে তিনি (আনোয়ারা বেগম) দাঁড়িয়ে হাত তোলেন। কিছু বলার অনুমতি চান। ছেলের চাকরির জন্য ৫ লাখ টাকার চুক্তির কথা এসপিকে জানান। তার কথা শুনে এসপি ফরিদ উদ্দিন টাকা না দেয়ার পরামর্শ দেন এবং চাকরির সার্বিক বিষয় বুঝিয়ে বলেন, পুলিশে যোগ্যতায় চাকরি হয়, টাকা নয়।

আনোয়ারা বেগম এসপির এই কথা জানালে আহমদ আলী ক্ষেপে যায়। সে দাবি করে, তাদের তদবিরেই ইমরানের চাকরি হয়েছে। গত শুক্রবার মাসুক নামের একজনকে সঙ্গে নিয়ে টাকার জন্য ইমরানের বাড়িতে আসে। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে- মোবাইল ফোনে ইমরানকে হত্যা ও চাকরি খেয়ে ফেলার হুমকি দেয়। এ সংক্রান্ত কথোপকথনের ১ ঘণ্টা ৩৮ সেকেন্ডের অডিও রেকর্ড আছে।

আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘জেল থেকে বের হয়েই আলী আহমদ আমার ছেলের ক্ষতি করবে। আল্লাহর পর একমাত্র এসপি স্যারই এই আলী আহমদের হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে পারেন।’

সাত্তারের পদ-পদবি না জানলেও ছবি দেখে ইমরান হোসেন নিশ্চিত করে বলেন, ‘আলী আহমদের পরিচয় করিয়ে দেয়া জকিগঞ্জের সাত্তারই জকিগঞ্জ উপজেলার সুলতানপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুস সাত্তার। ২৮ তারিখ সন্ধ্যায় সিলেট নগরীর বন্দরবাজার মধুবন মার্কেটের সামনে উনার সঙ্গে আমার কথা। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সাত্তার। তিনি বলেন, ‘আমি আলী আহমদকে চিনি। কিন্তু এ ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানি না।’

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে সিলেটের পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন বলেন, নিয়োগপ্রাপ্ত ইমরানের পরিবারের অভিযোগের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। ইমরানের মায়ের মামলায় আলী আহমদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ওই চক্রের সঙ্গে আরও যারা জড়িত তাদের খুঁজছে পুলিশ। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে তারা যত প্রভাবশালীই হোক আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি ইমরানের পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে পুলিশ।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর