ফের কেনা হচ্ছে ক্ষতিকর ব্যয়বহুল মেশিন

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই বাতিল, ক্ষতিকর মানবদেহের জন্যও। অথচ সরকারের সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরেজ ডিপার্টমেন্ট (সিএমএসডি) এমন ৫টি কোবাল্ট-৬০ মেশিন ক্রয় করছে। দুটি মেশিন কেনার কার্যাদেশ দেয়া হয়ে গেছে এবং বাকি তিনটি ক্রয়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ক্যান্সার রোগীদের রেডিও থেরাপি দেয়ার জন্য এ মেশিন শুধু ক্ষতিকরই নয়, ব্যয়বহুলও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে কার্যকর, আধুনিক, ব্যয় সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ রেডিও থেরাপি মেশিন হচ্ছে- লিনিয়ার এক্সিলারেটর। বিশ্ববাজারে এটি সহজপ্রাপ্যও। কিন্তু রহস্যজনক কারণে কেনা হচ্ছে কোবাল্ট-৬০। সূত্র বলছে, প্রভাবশালী একটি প্রতিষ্ঠান হয়তো তার স্বার্থে সরকারের উচ্চপর্যায়কে ভুল বুঝিয়ে এবং সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে মেশিনগুলো সরবরাহ করছে।

জানতে চাইলে জাতীয় ক্যান্সার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. ওবায়দুল্লাহ বাকী বলেন, উন্নত বিশ্বে কোবাল্ট-৬০ মেশিন একেবারেই অযোগ্য। এ মেশিন চূড়ান্ত পর্যায়ে ক্যান্সার রোগীদের ক্ষেত্রে কিছুটা ফলপ্রসূ। তবে ক্যান্সারের প্রাথমিক স্তর বা দেহের অভ্যন্তরের কোনো অঙ্গে ক্যান্সার হলে, সেখানে এ মেশিনের কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, এর রেডিয়েশন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাই ক্যান্সার কোষের সঙ্গে সুস্থ স্বাভাবিক কোষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া লাং ক্যান্সার, শরীরের ভেতরের টিউমার এমনকি ব্রেন টিউমারের ক্যান্সারের চিকিৎসায় এ মেশিন কার্যকর নয়। আরও খারাপ দিক হচ্ছে, দীর্ঘদিন কোবাল্ট-৬০ মেশিনে রেডিয়েশন নিলে রোগীর নির্ধারিত স্থানে চামড়ায় ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ঝুঁকিমুক্ত ক্যান্সার চিকিৎসায় লিনিয়ার এক্সিলারেটরের বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসান বলেন, দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় বেশি মানুষকে চিকিৎসা দিতে কোবাল্ট-৬০ মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অত্যাধুনিক লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিনের কাছাকাছি দামেই কোবাল্ট-৬০ মেশিন কেনা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাকে বলা হয়েছে, লিনিয়ার মেশিনের দাম কোবাল্ট-৬০ মেশিনের প্রায় দ্বিগুণ। তাই আমরা এটি কেনার অনুমতি দিয়েছি।

কথা হয় ক্যান্সার হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে। তারা বলেন, বাংলাদেশে এক ব্যক্তি একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে কোবাল্ট-৬০ মেশিন সরবরাহ করে। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের একজন পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে ওই ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

তারা জানান, বর্তমানে কানাডিয়ান একটি কোম্পানি সীমিত পর্যায়ে এ মেশিন তৈরি করছে। এছাড়া ভারতেও কোবাল্ট-৬০ মেশিন তৈরি হয়। ভারতের পরমাণু গবেষণা সংক্রান্ত নানা কাজে এ মেশিন ব্যবহার হচ্ছে। তবে ভারতে কোবাল্ট-৬০ মেশিন তৈরি হলেও সে দেশের প্রখ্যাত ক্যান্সার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতাল ১২ মার্চ ১২০টি লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন ক্রয়ে আমেরিকান কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিএমএসডি সূত্র বলছে, ১৫ মার্চ কোবাল্ট-৬০ মেশিন ক্রয়ে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী দরপত্রে ক’টি মেশিন ক্রয় করা হচ্ছে তা উল্লেখ থাকার কথা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা উল্লেখ নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট, কুর্মিটোলা হাসপাতাল ও শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জন্য একটি করে এ মেশিন কেনা হচ্ছে। সূত্র বলছে, এসব কোবাল্ট মেশিনের গড় মূল্য প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা।

অথচ এর সঙ্গে এক থেকে দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেই অত্যাধুনিক লিনিয়ার এক্সিলারেটর ক্রয় করা সম্ভব। এর আগে সিএমএসডি দুটি প্যাকেজে ৪টি কোবাল্ট মেশিন ক্রয়ে কার্যাদেশ দেয়। ৪টি মেশিনের আনুষঙ্গিকসহ মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৫০ লাখ ১১ হাজার ২৩২ মার্কিন ডলার। ৫ বছরে বিক্রয়োত্তর সেবাসহ মূল্য ঠিক হয় প্রায় ৩৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫০ বছর আগে লিনিয়ার এক্সিলারেটর বাজারে আসার পর থেকেই কোবাল্ট-৬০ মেশিনের উপযোগিতা কমতে থাকে। উন্নত দেশ এ মেশিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করে দেয়।

জাতীয় ক্যান্সার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. মফিজুর রহমান বলেন, লিনিয়ার এক্সিলারেটর অবশ্যই ভালো। ওই মেশিনের যত আধুনিক ব্যবহার আছে কোবাল্টে তা নেই। তবে কোবাল্ট-৬০ মেশিনও খারাপ নয়।

এটি টানা ৫ বছর চালানো যায়। তাই আমরা এ মেশিন ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমি মনে করি, আমাদের দেশে আগামী ১০ বছর কোবাল্ট ব্যবহার করতে হবে। কেননা লিনিয়ার ব্যবহার করার মতো দক্ষ লোক নেই। দক্ষ লোক তৈরি হলেই লিনিয়ার কিনতে হবে। ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের কর্মরত চিকিৎসক ও টেকনোলজিস্টরা জানান, কোবাল্ট মেশিনে যারা কাজ করেন তাদের শরীরেও তেজস্ক্রিয়তা ছড়াতে পারে, যার কারণে হতে পারে ক্যান্সার। সেদিক থেকে লিনিয়ার মেশিন তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায় না, যথেষ্ট নিরাপদ।

রেডিয়েশন অনকোলজিস্টরা জানান, কোবাল্ট-৬০ মেশিনে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করা হয় ক্ষতিকর গামা রশ্মি। নির্দিষ্ট সময় পরপর এর সোর্স পরিবর্তন করতে হয়। একেকটি সোর্সের মূল্য আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা। যে দু-একটি দেশ কোবাল্ট-৬০ ব্যবহার করছে, তারা নিজেরাই এ সোর্স উৎপাদন করে থাকে। এক্ষেত্রে তারা নামমাত্র মূল্যেই সোর্স পাচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে এ সোর্স ব্যবহার করে রেডিও থেরাপি দেয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ।

আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, কোবাল্ট-৬০সহ সব আয়নীভবন বিকিরণ ক্যান্সার সৃষ্টিকারী। অতএব কোবাল্ট-৬০ এর থেকে গামা রশ্মি বিকিরণে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কোবাল্ট-৬০ মেশিনে চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে অনেক রোগীই তাদের পূর্ণ শক্তি ফিরে পান না। অনেক রোগীর মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, এমনকি চেতনা হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। চুল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, চামড়ায় প্রদাহ, এমনকি অনেকের ক্ষেত্রে ক্ষুধামন্দার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়ে থাকে।

দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজিস্টরা বলছেন, প্রতিটি কোবাল্ট-৬০ মেশিন প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকায় কেনা হচ্ছে, প্রকৃত দামের তুলনায় অনেক বেশি। এ দামেই সর্বাধুনিক প্রযুক্তির লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন কেনা সম্ভব। স্বাস্থ্য ঝুঁকি, আর্থিক ক্ষতি থাকার পরও কেন বারবার কোবাল্ট মেশিন কেনা হচ্ছে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

কোবাল্ট-৬০ মেশিনে সরসারি গামা রশ্মি এক্সপোজার ব্যবহার করা হয়। এটি মারাত্মক তেজস্ক্রিয় পদার্থ। তেজস্ক্রিয় পদার্থ রক্ষণাবেক্ষণে অত্যধিক সতকর্তা অবলম্বন করতে হয়। এর আগে সামান্য অসাবধানতা থেকে মারাত্মক তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ায় অসংখ্য মানুষ হতাহত হয়েছেন।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর