“১ টাকার সিঙ্গারায়” ঘুরে দাঁড়িয়েছে মনোয়ারা

এক টাকার সিঙ্গারা। প্রতি পিস মাত্র এক টাকা। ক্রমবর্ধমান নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বর্তমান অবস্থায় এটিকে কাল্পনিক বা অসম্ভব বলে মনে হতে পারে। ফাস্ট ফুড বিক্রেতারাও এক টাকার সিঙ্গারাকে অলাভজনক মনে করতে পারেন।

তবে এক টাকায় সিঙ্গারা বিক্রি করেও যে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব তার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন রাজশাহী নগরীর মনোয়ারা বেগম মুনি নামের এক জীবন সংগ্রামী নারী। মাদকাসক্ত স্বামীর নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ‘এক টাকার সিঙ্গারা’ উদ্যোগের মাধ্যমেই এখন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি।

অন্য মেয়েদের মতোই একটি সুন্দর দূরন্ত শৈশব পেরিয়ে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিলেন মনোয়ারা বেগম (মুনি)। কিন্তু চাল আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে দূরন্ত শৈশবের আড়ালে মিলেছে গৃহকর্মীর কাজ।

এরমধ্যেও ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন মুনি। তবে বাবা-মায়ের ইচ্ছায় বাল্য বিয়ের রোষানলে পড়ে বই ছেড়ে বধু বেশে স্বামীর সংসারের সারথি হতে হয়েছে। স্তব্ধ হয়েছে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন।

বিয়ের পরে মাদকাসক্ত স্বামীর ভালোবাসার বিপরীতে মিলেছে নিষ্ঠুর নির্যাতন। ভেবেছিলেন সংসারে সন্তান আসলে হয়তো স্বামীর ভালোবাসায় নতুন একটি জীবন পাবেন। কিন্তু দুই বছরের ব্যবধানে দুইটি পুত্র সন্তানের জন্ম হলেও নির্যাতনের মাত্রা হালকা হয়নি।

এরপরই পাঁচ বছরের দাম্পত্ত জীবনের ইতি টানটে হয়েছে। তবে দমে যাননি তিনি। নওগাঁর প্রত্যান্ত একটি গ্রাম ছেড়ে নতুন জীবনের সন্ধানে দুই সন্তান নিয়ে ২০০৭ সালে রাজশাহী নগরীতে পাড়ি জমান। শুরুতে রাজশাহী নগরীর সাধুর মোড় এলাকায় শিক্ষার্থীদের মেসে রান্না করে দুই সন্তান নিয়ে আবারও নতুন সংসার সাজাতে থাকেন মনোয়ারা বেগম। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে এভাবেই মানুষের বাড়ি আর মেসে রান্না করে সংসার চালাতে থাকেন।

কিন্তু মাসে পাঁচ হাজার টাকার আয় দিয়ে বাসা ভাড়া, সংসারের খরচ মিটিয়ে দুই সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। অভাবের সংসারে সন্তানদের পড়াশোনাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিলো। এরমধ্যে করোনার আগ্রাসী রুপের ছায়া পড়ে সংসারে। কর্ম হারালেও জীবিকা থেমে থাকেনি। গত চার মাস আগে নওহাটা ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছেলে মাইনুল ইসলাম শুভ এর সঙ্গে সংসারের অভাব-অনটনের গল্প করতে করতে কান্না করছিলেন মা মনোয়ারা বেগম।

সে সময় ছেলে মাইনুল ইসলাম শুভ ইউটিউবের একটি ভিডিও দেখে মাকে ‘এক টাকার সিঙ্গারার’ উদ্যোগের কথা বলেন। সেই দিনই মনোয়ারা বেগম এক টাকার ৬০ টি সিঙ্গারা তৈরি করেন। প্রতিবেশিদের জানাতেই তা মুর্হূতের মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। এরপর থেকেই আর ফিরে তাকাতে হয় নি।

মনোয়ারা বেগম মুনি জানান, ছেলের কথাই প্রথম ৬০ টা সিঙ্গারা তৈরি করেছিলেন। যা বিক্রি হতে সময় লাগে নি। ক্রেতা চাহিদা থাকায় সেই দিনই প্রায় ৬০০ টাকার মতো সিঙ্গারা বিক্রি করেছিলেন। এরপর প্রতিদিনিই ৬০০ থেকে এক হাজার টাকার সিঙ্গারা বিক্রি হতে থাকে। কিন্তু সপ্তাহ না পেরুতেই বাড়ি মালিক জানায় বাসায় এভাবে সিঙ্গারা বিক্রি করতে দেয়া যাবে না। তবে আশাহত হননি তিনি।

স্থানীয় এক আত্মীর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে নগরীর সাধুর মোড়ে ছোট্ট একটি দোকান ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন এক টাকার সিঙ্গারার দোকান। যেখানে বিদ্যুৎ বিলসহ প্রতিমাসে এক হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। আর এই দোকানে প্রতিদিন প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজারের অধিক সিঙ্গারা বিক্রি হয়। যা থেকে প্রতিমাসে তাদের আয় এখন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।

মনোয়ারা বেগম মুনি বলেন, আমার দোকানে এখন বেচাবিক্রি অনেক। একেক জন ১০০ থেকে শুরু করে এক হাজার পর্যন্ত সিঙ্গারা নিয়ে যান। অগ্রিম অর্ডারও পাওয়া যায়। নগরীর বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসে সিঙ্গারা খেতে। এখন এই ব্যবসায়কে পুঁজি করে সন্তানের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াসহ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান বলেন জানান এই নারী।

নগরীর সাধুর মোড় এলাকায় অবস্থিত এই ‘এক টাকার সিঙ্গারা’ উদ্যোগে মুনির পাশাপাশি আরও কয়েক জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। দুই ছেলেসহ মোট ৬ জন লোকবল নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন মুনি। প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে এই এক টাকার সিঙ্গারা। শুক্রবার (২৭ আগস্ট) এই দোকানে গিয়ে দেখা যায়, বেচাকেনায় ব্যস্ত সময় পার করছেন মা-ছেলে।

ছেলে মাইনুল ইসলাম শুভ বলেন, মা আমাকে ও ছোট ভাইকে অনেক কষ্ট করে লালন পালন করেছেন। অভাবের সংসারে কোন উপায় না দেখে এমন একটি ব্যবসায় আসতে হয়েছে। এটাতে সংসারে অনেকটায় স্বচ্ছলতা এসেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি আমি ও আমার ছোট ভাই সোলাইমান মাকে সহযোগিতা করছি। আশা করছি এই উদ্যোগটিকে আরও সামনে নিয়ে যেতে পারবো।

এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শবনম শিরিন জানান, মনোয়ারার মতো আরও অনেকেই একটা সময় নির্যাতনের শিকার হয়ে জীবন সংগ্রামে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। এসব নারীদের নিয়ে মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় কাজ করছে। তাদেরকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ও তাদের উদ্যোগগুলোকে এগিয়ে নিতে প্রশিক্ষণসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে। আর মনোয়ারার বিষয়টি সোনার দেশ প্রতিবেদকের মাধ্যমে জানতে পারলাম। খোঁজ নিয়ে তাকেও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।

মাহাবুল ইসলাম/বার্তা বাজার/টি

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর