ভাসমান যৌনকর্মী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষজন কেমন আছে ?

(ছদ্মনাম) সুস্মিতা। তার বাড়ি পটুয়াখালী জেলায়। সুস্মিতার ডিভোর্স হয় ১৬ বছর আগে। তিনি প্রায় ১৫ বছর ধরে গাজীপুর জেলার শ্রীপুরের বিভিন্ন এলাকায় পতিতাবৃত্তি করে তার তিন সন্তানকে নিয়ে বসবাস করছেন।

বুধবার (২৮ জুলাই) মধ্যরাতে সুস্মিতাসহ ৫ জন ভাসমান যৌনকর্মীর সঙ্গে বার্তা বাজারের প্রতিনিধির বিস্তারিত কথা হয়। তারা লকডাউনে তাদের দুর্দশার কথা জানান।

সুস্মিতার দুই ছেলের মধ্যে একজন মাদ্রাসায় পড়ে, অপরজন কাঠমিস্ত্রীর কাজ শিখছে। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কয়েকমাসের মধ্যেই পারিবারিক কলহের জেরে ডিভোর্স হয়ে যায়।

সুস্মিতার গল্পটা শুরু যাক। অন্য ১০ জন নারীর মতোই তারও একটি সাজানো সংসার ছিল। কিন্তু তার স্বামী আবু তাহের প্রতিনিয়ত নেশা করতো। এক সময়ে নেশা করতে করতে ভিটেমাটি বিক্রি করে দেয় আবু তাহের। পরে একদিন সুস্মিতার বড় ছেলের টাইফয়েড ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। চিকিৎসার অভাবে তার ছেলের কান্না আর শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেনি সুস্মিতা।

সুস্মিতা জানান, তার এক বাল্যবন্ধু কয়েকবার কুপ্রস্তাব দেয়। তখন রাজী না হলে সেই বাল্যবন্ধু বলে, জীবনে কখনও কোনও কাজে লাগলে জানিয়ো, এই বলে মোবাইল নম্বর দেয়।সুস্মিতার বড় ছেলের দুর্দশায় চিকিৎসা করাতে না পেরে দিশেহারা হয়ে যায় তিনি।

অতঃপর সেই বাল্যবন্ধুর কথা মনে পড়ে তার। তাকে ফোন করে আর্থিক সহায়তা চাইলে সে বলে তার ছেলের চিকিৎসার সকল খরচ দেবে। বিনিময়ে তার কথা শুনতে হবে।

একদিকে ছেলের অসুস্থতা, অন্যদিকে স্বামীর নেশাগ্রস্থতা ও সাংসারিক অভাব-অনটন, সব মিলিয়ে সুস্মিতা ছেলেকে বাঁচানোর স্বার্থে সেই বাল্যবন্ধুর কুপ্রস্তাবে রাজী হয়। এরপর থেকেই তার মাথায় চিন্তা আসে। বাধ্য হয়েই সে তার নেশাগ্রস্ত স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে তিন সন্তানকে নিয়ে অন্ধকার পথে পা বাড়ান সুস্মিতা। পেটের দায়ে হয়ে ওঠেন যৌনকর্মী। করোনার এই সময়ে সুস্মিতার দুঃসময় চলছে।

এইতো গেল সুস্মিতার বাস্তব গল্প। বাকী চারজনের মধ্যে দুইজন মধ্যবয়সী নারী এবং দুইজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। তারা সকলেই শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তা ফ্লাইওভারের নিচে এবং বনরুপা সিনেমা হল সংলগ্ন এলাকায় থাকেন।

সুস্মিতার সঙ্গেই অর্থাৎ একইসঙ্গে এই কাজ করেন গৃহবধূ (ছদ্মনাম) সুইটি। সুইটি মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় ভাড়া থাকেন। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলায়। গত বছরের করোনার শুরুর দিকে সুইটি এই পেশা বেঁছে নেন।

এই পেশায় আসার কয়েকদিন আগেই সুইটির স্বামী আরেকটি বিয়ে করে। তাই দুই ছেলে। একজনের বয়স (১৩) অপরজনের (৯)। সুইটির স্বামীও বিভিন্ন নেশায় আসক্ত। তার দুইটি ছেলেই হাফিজিয়া মাদ্রাসায় পড়াশুনা করছে।

এই কাজ করে সন্তানদের পড়াশুনা ও সংসারের খরচের যোগান দেয় সুইটি। কোনোদিন এক হাজার অথবা কোনোদিন দুই হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারে সুইটি।

এই আয় বিলাসিতার জন্য নয়, তার দুই সন্তানদের নিয়ে দুবেলা দু মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার আয় বলে জানান সুইটি। তবে এই করোনায় তার আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুবই দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

বিস্তারিত কথা হয় দুইজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে। তারা হলেন, (ছদ্মনাম) তানিয়া ও সুমি। তারা বলেন, আমাদেরকে সমাজ অনেক ছোট করে দেখে। আমরাও তো মানুষ। আমাদেরও তো পেট আছে। মানুষের কাছে চেয়ে খেতে গেলে নানান ধরণের কটু কথা শুনতে হয়।

হিজড়া নামের মতো জঘন্য গালি শুনতে হয়। আমরা জন্মগত ভাবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। সৃষ্টিকর্তাই তো আমাদের এভাবে সৃষ্টি করেছে, এতে তো আমাদের কোনও হাত নেই। আমরা সব শ্রেণির মানুষের কাছে অবহেলার পাত্র হয়ে থাকবো আর কতকাল ? লকডাউনে কাজ না থাকায় না খাওয়া অবস্থা প্রায়। তানিয়া ও সুমি দুইজনেই কাজের সন্ধান করেছিলেন, কোনও কাজ না পেয়ে বাধ্য হয়েই এই পেশা বেঁছে নিয়েছেন বলে জানান তারা।

মাওনা চৌরাস্তা ফ্লাইওভারের অপর প্রান্তের আরেক যৌনকর্মী (ছদ্দনাম) বৃষ্টি। তিনি জানান এই লকডাউনে তার অবস্থা খুবই খারাপ। গত দুইদিন ধরে কর্মহীন তিনি। প্রায় না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা। তার গল্পটাও প্রায় একইরকম। স্বামী নেশা করতো। স্বামী নিজেই তাকে এ পেশায় আসতে বাধ্য করে।

বাড়িতে এসে নেশা করে বন্ধুদের নিয়ে শুরুর দিকে খারাপ কাজ করাতো। পরে বৃষ্টি তাকে ডিভোর্স দিয়ে প্রায় ৭ বছর যাবত মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় ভাসমান যৌনকর্ম করছে।

বিয়ে করার কোনও চিন্তাভাবনা আছে কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে সবাই প্রায় একই কথা জানায়। তারা বলেন, এই পেশায় আসার পরও অনেকে স্বপ্ন দেখিয়ে বিয়ে করে। পরে তারাও আমাকে দিয়ে অবৈধ কাজ করাতে চায়। এরপর থেকে বিয়ের চিন্তা কখনও মাথায় আনেন না। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। তবে তারা কেউই সরকারি ত্রাণ সহায়তা পাননি বলে জানিয়েছেন।

এসব বিষয়ে শ্রীপুর উপজেলা দুর্নীতি দমন কমিটির সদস্য ও কলামিস্ট সাঈদ চৌধুরী বলেন, যে যেই পেশায়-ই থাকুক না কেন, যদি কেউ ক্ষুধার্ত থাকে, তাহলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তাদের সহায়তা করা উচিত।

‘একরঙা একঘড়ি’ প্রকাশনার প্রকাশক নীল সাধু মূলত শিশু ও শ্রমজীবীদের নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু গেল বছরে করোনার শুরুর দিকে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর ৫০০ জন যৌনকর্মীকে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছেন।

তিনি বলেন, “এ পেশায় কেউই স্বেচ্ছায় আসে না, কেউ পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, বিভিন্ন লঞ্চ-টার্মিনাল-রেলওয়ে স্টেশনে থেকে ছোট থেকে বড় হওয়া বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোই এ পেশায় বেশি আসছে। যৌনকর্মীদের নিয়ে ঢাকায় কয়েকটি সংগঠনকে কাজ করতে দেখেছি, তবে জেলা শহরগুলোতে তেমনটা নেই। সরকারি উদ্যোগে তাদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের সহায়তা করা প্রয়োজন।”

শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম জানান, “ভাসমান পতিতা এবং তৃতীয় লিঙ্গের যারা খাদ্যাভাবে রয়েছে তাদের তালিকার আওতায় এনে ত্রাণ দেওয়া হবে”।

ফিরোজ শাহ্/বার্তা বাজার/টি

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর