অনুভূতিতে প্রিয় হুমায়ুন আহম্মেদ

আজ ১৯ জুলাই। ১৯ সংখ্যাটি বড়ই ভয়ংকর। কেননা আজকের এই দিনে বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক নিলীমা রেখা অঙ্কিত হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী মহাপুরুষ এইদিনেই তার লিখনি বন্ধ করে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। যিনি বাংলা সাহিত্যের সর্বত্র বিচরণ করেছেন এবং সাহিত্যকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য মাত্রায়। যে মহান সাহিত্য পুরুষ সৃষ্টি করেছেন হিমু, রুপা, মিসির আলীর মত অনেক জনপ্রিয় চরিত্র।

আমি কার কথা বলছি, তা মনে হয় এতক্ষণে আপনারাও বুঝে গেছেন। আর হ্যা, নাই বুঝবেন বা কেন? কে বা না চিনে বাংলা সাহিত্যের জগতে এই উজ্জ্বল নক্ষত্রকে? তিনি আর কেউ নন। তিনি হলেন কথাসাহিত্যিক ড.হুমায়ুন আহম্মেদ।

আজ তার নবম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১২ সালের ১৯ শে জুলাই বাংলা আধুনিক কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের পথিকৃৎ হুমায়ুন আহম্মেদ শতশত ভক্তদের কাঁদিয়ে চলে গেলেন এক অন্ধকারাছন্ন অদৃশ্য জগতে। যেখানে কেউ কোন যোগাযোগ করতে পারে না। না পারা যায় এখান থেকে না পারে ওখান থেকে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীদের হাতে ধরা পরার পর কাকতালীয়ভাবে বেঁচে যান তিনি। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই ওই দিনটা যদি আবার কাকতালীয় হত, তবে তো আর বেদনার নীল রংয়ে বাংলার আকাশ নিলীমা রেখা আঁকা হত না।

যদি ক্যালেন্ডার থেকে ১৯ জুলাই ২০১২ দিনটা মুছে ফেলা যেত! সময়ের মহাকালে দিনটা আর না-ই আসত! যদি ক্যান্সার নামক দানবের জন্ম না ঘটত পৃথিবীতে! তবে কি আজ বেঁচে থাকতেন বাংলার সাহিত্যে আকাশের এই নক্ষত্র? কলম আর ক্যামেরা দিয়ে তিনি তার জাদু দেখিয়েছেন। তিনি কলমকে বলতেন তার হাতের ষষ্ঠ আঙ্গুল। আর ক্যামেরা? তার তৃতীয় চোখ।

১৯ শে জুলাই ২০১২। সাত সমুদ্রে তেরো নদী ওপার থেকে সেদিন মৃত্যু সবচেয়ে অনিবার্য সত্য হয়ে নেমেছিল যার জীবনে। হুমায়ুন আহম্মেদ জীবদ্দশায় হয়েছেন তারকা আর মৃত্যুতে হয়েছেন নক্ষত্র। বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাকে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছুই নেই। তিনি হিমুদের জন্মদাতা, তিনি মিসির আলীকে সৃষ্টি করেছেন।

তিনি পিতা!
জন্মের আগেই যে কন্যা মৃত্যুকে ভালবেসে বরণ করে ছিলেন। তিনিই লীলাবতী পিতা। তাই পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে তিনি চলে গেলেন সেখানে, যেখানে রয়েছে তার লীলাবতী।

ইতিহাস থেকে শুনেছি, ১৯ শে জুলাই ১২৯৬ সালে জালালুদ্দিন খিজলিকে হত্যা করে দিল্লির সিংহাসন দখল করে আলাল উদ্দিন খিজলি। কিন্তু ১৯ জুলাই তোমাকে হত্যা করে পারে নি কোন শক্তি তোমার অদৃশ্য শক্তির লিখুন দ্বারা পাঠকের মনে স্হান করে নেওয়া ভালবাসা আর শ্রদ্ধ্যার স্হান দখল করতে। মনে হয় আর কেহই পারবেও না। কেননা তুমি বেঁচে আছ ভক্তদের মনের মনিকোঠায়।
কে জানত, ১৭৬৩ সালের ১৯ জুলাই বক্সারের যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিশ্বাস ঘাতকতার বলি হয়ে মীর কাসেমের পরাজয়ের মত ক্যান্সারের নিকট তোমাকেও পরাজয় বরণ করতে হবে!
তুমি বনফুল আর ডি.এল.বায়ের মত আজকের এই দিনে পুনঃজন্মগ্রহন কর।

আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে কাদঁছে শত শত পাঠক, ভক্ত, কাঁদছে বাংলার নীল আকাশ। আজ এই মহান পুরুষের মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই শত শ্রদ্ধা আর হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা।

যাই হোক প্রকৃতিতো তার আপন নিয়মেই চলে। যার জন্ম আছে তার মৃত্যুতো অনিবার্য। এজন্যই মনে হয় তিনি লিখেছিলেন –

মরিলে.. কান্দিস না আমার দায়রে যাদু ধন, মরিলে কান্দিস না আমার দায়।
সূরা ইয়াসিন পাঠ করিও বসিয়া কাছাই,
যাইবার কালে বাঁচি যেন শয়তানের ধোকায়।
মরিলে.. কান্দিস না……..

হুমায়ুন আহম্মেদ স্যার যে শুধু একজন লেখক ছিলেন এটাই তার পরিচয় নয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞানের একজন গুণী অধ্যাপক ছিলেন।তিনি ছিলেন একাধারে খ্যাতিমান চলচিত্রকার,চলচিত্র নির্মাতা, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক।

যদিও তিনি শহরে বাস করতেন তদাপি তিনি পারেন নি গ্রামের জন্মস্থানের ভালবাসার ইতি টানতে। তিনি যখনই সময় পেতেন তখনই চলে যেতেন তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলাধীন কুতুবপুর গ্রামে। তিনি গ্রামকে কতটুকু ভালবাসতেন তার প্রমাণ তার হাতে গড়া ” শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ” নামক স্কুলটি। তিনি অজপাড়া গাঁয়ে সুবিধার বঞ্চিত কিশোর-কিশোরীদের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে প্রতিষ্ঠা করেন “শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ”। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠান থেকে শত শত ছেলেমেয়ে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে শুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে।

আমি নিজেকে খুবই গর্বিত মনে করি যে প্রিয় স্যারের এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম ব্যাচের প্রথম ছাত্র হতে পেরে এবং সেই সাথে নিজ চোখে স্যারের দর্শন পাওয়াতে। আমি আজও ভুলতে পারি না তাঁর স্নেহমাখা হাত বুলানো আশির্বাদের কথা। স্যারের মৃত্যুর কিছুদিন আগে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক শুভক্ষণের যখন তিনি স্কুলে গিয়েছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন আগামী বছর সুবিধাজনক সময়ে সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সেন্টমার্টিন / নারকেল জিঞ্জার নিয়ে যাবেন। যেখানে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন পর্যটকদের মাঝে সাহিত্যে খেলার এক দর্শনীয় স্থান। কিন্তু যাওয়া হল না আর সেখানে। তাই দেখতেও পারি নাই কি দেখাতে চেয়েছিলেন!

আমার মত শতশত শিক্ষার্থী রয়েছে তাঁর হাতে গড়া এই শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠে। যারা তাদের মনের ভিতরে যত্ন করে রেখেছে এই প্রিয় ব্যক্তিটির নাম। তাই হুমায়ুন আহম্মেদ স্যারকে স্মরণে রাখার জন্য তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানের সকল প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা গড়ে তোলেছে ” শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ পরিবার” নামে একটি সংগঠন। প্রতিবছর জে.এস.সি. বা এস.এস.সি. পাস করে সদস্য হচ্ছে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা।

এই সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিবছর স্যারের স্মৃতিতে জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী, হুমায়ুন বইমেলারসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এবছর সীমিত পরিসরে স্যারের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছে “শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ “এবং উক্ত সংগঠনটি।

“শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ পরিবার” এর সদস্যদের স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে ” হুমায়ুন ব্লাড সোসাইটি “। এখান থেকে যে কেহ তাদের প্রয়োজনে বিনামূল্যে রক্ত সংগ্রহ করতে পারে। ২০১৯ সালে বাংলা কথাসাহিত্যের সংলাপ প্রধান নতুন শৈলীর জনক হুমায়ুন আহম্মেদের ৭১ তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁরই সহোদর বিজ্ঞান মনস্ক লেখক প্রখ্যাত গুণীজন ড.মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এবং হুমায়ুন আহম্মেদ স্যারের সহধর্মিনী বর্তমান প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি চিত্রনায়িকা ও স্হপতি মেহের আফরোজ শাওন “হুমায়ুন ব্লাড সোসাইটি” এর উদ্বোধন করেন।

ড. জাফর ইকবাল স্যার এই দিন আমাকে জিজ্ঞাস করেছিলেন তোমাদের এই সংগঠনের একটা ফিউচার প্ল্যান বল যে তোমরা কি করতে চাও? আমি বললাম যে আমরা এই কালজয়ী লেখকের স্মরণে একটি বড় আকারের হুমায়ুন মেলা করতে চাই। আর সেখানে স্হান পাবে গ্রামীণ সংস্কৃতি এবং বিলুপ্ত প্রায় বিভিন্ন গ্রামীন খেলাধুলা। তখন তিনি আমাদের আশস্ত করেন যে তিনি উক্ত মেলায় স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করবেন।

বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকরাই স্যারের স্বপ্ন বাস্তবায়নে শিক্ষার্থীদেরকে বাস্তবমুখী এবং প্রকৃত শিক্ষা দিয়ে আসছেন। যার প্রমাণ হিসেবে সাক্ষী রেখে আসছে প্রতিবছর জে.এস.সি. এবং এস.এস.সি. সহ যে কোন প্রতিযোগিতামূলক ইভেন্টে ঈর্ষান্বিত ফলাফল। যাই হোক, আজও তাঁর স্মৃতিকে আকঁড়ে ধরে আছে তাঁহার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় ও সংগঠনটি।

পরিশেষে বলতে চাই, হুমায়ুন আহমেদ আছেন, তিনি থাকবেন পাঠক ও ভক্তদের হৃদয়ে। যতদিন থাকবে বাংলা ভাব আর ভালবাসা। বাংলা সাহিত্যের এই বিরল প্রতিভার নবম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

লেখক-মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি; শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ পরিবার।

হুমায়ুন আহম্মেদ প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় “শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ” এর প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সংগঠন।

বার্তা বাজার/টি

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর