আ’লীগ: এক যুগের অধিক ক্ষমতায় থেকেও দলের কার্যক্রমে স্থবিরতা

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যে গতবারের মতো এবারও তাদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালন করছে সীমিত কর্মসূচির মাধ্যমে।

টানা এক যুগ ধরে ক্ষমতায় রয়েছে দলটি, তবে এখন ৭২ বছরের প্রাচীন এই আওয়ামী লীগ এবং সরকার একাকার হয়ে গেছে কিনা – আওয়ামী লীগের ভেতরেও এমন প্রশ্ন উঠছে।

দলের নেতাদের অনেকে বলেছেন, সরকার এবং দলের মধ্যে পার্থক্য হারিয়ে ফেলার কারণে তাদের দলীয় কর্মকাণ্ড এখন দিবস-ভিত্তিক কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তা কতটা বিবেচনায় নিচ্ছে, দলটির মাঠ পর্যায়ে সেই প্রশ্নও রয়েছে।

স্থানীয় পর্যায়ে দলের মধ্যে প্রকট কোন্দল
সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচিত হয় নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জাকে ঘিরে কর্মকাণ্ড।

মি: মির্জা এবং তার পাল্টা গ্রুপের মধ্যে কোন্দলের জেরে সেখানে দফায় দফায় সংঘর্ষ, অস্ত্রের ব্যবহার, হতাহতের ঘটনাও ঘটেছিল।

এর পেছনে ক্ষমতা এবং গোষ্ঠীগত স্বার্থ ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

শুধু কোম্পানীগঞ্জেই নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় দলটিতে কোন্দল প্রকট হয়েছে।

দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে যে, দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার কারণে ‘কিছু পাওয়া না-পাওয়ার’ প্রশ্নে আওয়ামী লীগে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বেড়েছে।

‘ত্যাগী নেতাকর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছেন’

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে আওয়ামী লীগের একজন নেত্রী জিনাত সোহানা চৌধুরী বলেছেন, ব্যক্তিস্বার্থ বা সুবিধা পাওয়ার প্রশ্ন যখন সামনে আসছে, তখন মাঠের ত্যাগী নেতাকর্মীরা ‘নিস্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছেন।’

তিনি আরও বলেছেন, সুবিধা পাওয়ার জন্য দলের বাইরে থেকেও অনেকে তাদের দলে আশ্রয় পাচ্ছেন। তারাই বেশি ক্ষতি করছে বলে তিনি মনে করেন।

“বিভিন্ন সময় ক্ষমতার পালা বদলের সাথে সাথে বিভিন্ন দল থেকে যারা তাদের দল পরিবর্তন করে, এরকম কিছু সুবিধাবাদী মৌসুমী পাখির মতো লোকজন আমাদের দলে ঢোকার জন্য অপচেষ্টায় আছেন। তাদের অনেকে এ দলে এসেছেন” – বলেন জিনাত হুদা চৌধুরী।

তিনি উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরেন ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার ছাত্রদলের একজন নেতার সেখানে ছাত্রলীগের পদ পাওয়ার ঘটনা।

“কিছু দিন আগে ছাত্রদলের একজন ছাত্রলীগেও পদ পেয়েছে। তাকে ছাত্রলীগ থেকে পরে বহিস্কার করা হয়েছে। এই জিনিসগুলো তো হচ্ছে।”

‘কিছু পাবার চেষ্টা’
বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে যে, একেবারে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত “কিছু পাওয়ার চেষ্টায়” ব্যস্ত রয়েছে তাদের দলের একটা অংশ।

অনেক এলাকায় মন্ত্রী এবং এমপিকে ঘিরে একটা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তারা এলাকার উন্নয়নসহ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন।

ফলে দিবস পালন করা ছাড়া দলের সাংগঠনিক তৎপরতা সেরকম কিছু নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিনাত হুদা ওয়াহিদ মনে করেন, প্রাচীন দলটি যে ক্ষতির মুখে পড়ছে-সেটা তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের বিবেচনায় নেয়া উচিত।

“১২ বছর ধরে তো আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় আছে। দল হিসাবে আওয়ামী লীগ কোন অবস্থায় আছে – সে প্রশ্নটি কিন্তু এখন উঠে যাচ্ছে। কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, দলের যারা ডেডিকেটেড নেতা কর্মী আছে, তাদের অনেকেই তো এখন প্রান্তিক পর্যায়ে চলে গেছে। অনেকে নিস্ক্রিয় হয়ে গেছেন” – বলেন জিনাত হুদা ওয়াহিদ।

‘প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তাই দল ও সরকার একাকার’
বিশ্লেষকদের অনেকে আবার বলেছেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনকে অকার্যকর করার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের প্রবল দাপটের মুখে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিও রাজনৈতিকভাবে অকার্যকর হয়ে রয়েছে।

সংসদে বিরোধীদল হিসাবে জাতীয় পার্টি থাকলেও তারা সরকারের অনুগত বলে মনে করা হয়।

ফলে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের সামনে কোন চ্যালেঞ্জ নেই।

সে কারণেই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক তৎপরতা নেই বলে মনে করেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ।

“সরকার এবং রাষ্ট্রে এই দল (আওয়ামী লীগ) বিলীন হয়ে গেছে। আর যেহেতু মাঠে কোন প্রবল প্রতিপক্ষ দৃশ্যমান নেই, ফলে বাইরে থেকেও কোন চ্যালেঞ্জ আসছে না” – বলেন মি: আহমদ।

তিনি আরও বলেন, “এখন রাষ্ট্রের সঙ্গে এবং অন্যান্য সামাজিক শক্তি যারা রাষ্ট্রে স্টেকহোল্ডার, তাদের সাথে একটা রসায়ন তৈরি করে আওয়ামী লীগ যেভাবে ক্ষমতায় আছে, এখানে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি হয়ে গেছে। এখানে আর জনগণ কেন্দ্রিক রাজনীতিটা নেই।”

বিভিন্ন সময় সরকার এবং দলের মধ্যে পার্থক্য তৈরির কথা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব থেকেই বলা হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি।

শেখ হাসিনা একইসাথে সরকার প্রধান এবং দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ নেতাদের অনেকে মন্ত্রী এবং দলের পদে রয়েছেন।

দলের নেতারা মনে করেন, কোন সংকট নেই
তবে দল কোন সংকটে পড়েছে এবং সরকার ও দল একাকার হয়ে গেছে-এসব বক্তব্য মানতে রাজি নয় দলটির নেতৃত্ব।

আওয়ামী লীগে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, দলীয় সরকার হলে কোন পার্থক্য থাকার প্রয়োজন নেই বলে তারা মনে করেন।

“দলীয় ব্যক্তিরা যখন এমপি হন, তখন তারা মন্ত্রী হবেন। সেই সরকারতো দলীয় সরকারই হবে।”

“যেহেতু আমরা ১২ বছর ক্ষমতায়, সেজন্য আমাদের মধ্যে হয়তো নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার কারণে কোন কোন জায়গায় কিছুটা দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দূর্বলতা কখনও ছিল না এবং এখনও নাই” – বলেন মি: হানিফ।

আওয়ামী লীগ নেতারা মুখে যাই বলুন – বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার এবং দলের মধ্যে পার্থক্য নেই।

তারা বলেন, প্রাচীন দল আওয়ামী লীগকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে এই সংকট।-বিবিসি বাংলা।

বার্তা বাজার/এসজে

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর