স্বাধীনতার ঘোষক এবং আমৃত্যু এক গণতন্ত্রীর নাম ‘শহীদ জিয়া’

শহীদ জিয়া ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ জাতির দুর্দিনে নিজের জীবন বাজি রেখে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অসম সাহসিকতার পরিচয় দেন। দেশবাসীকে দিক-নির্দেশনা দেন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান। তাঁর এই ঘোষণার কারণে জনগণ উজ্জীবিত হয়, দিক-নির্দেশনা পায়। জাতি, ধর্ম ও দলমত নির্বিশেষে সকলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরে দ্বিতীয়বার ৩০ মার্চ অন্য এক ঘোষণার মাধ্যমে, নিজেকে তিনি কমান্ডার ইন চীফ অব বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস ঘোষণা করেন। ওই সময় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ সীমান্ত পার হয়ে কলকাতা, আসাম, মেঘালয় ও আগরতলার বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেন। ভারত সরকারের সহযোগিতায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁরা নিজেদের সংগঠিত করেন এবং ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে, প্রবাসে বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। মেজর জিয়া অন্য অফিসারদের মতো একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরে তিনি ‘জেড ফোর্স’-এর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এরই মাধ্যমে তিনি দেশের জনগণ, দেশের আইন ও রাজনীতিবিদদের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধার প্রমাণ দিয়েছেন।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে শহীদ জিয়া সরাসরি দেশ শাসনের সংগে জড়িত হন, এর আগেই দেশে মার্শাল ল’ চালু ছিলো। ক্ষমতাসীন হবার পর সবাইকে বলতেন, সামরিক সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়েছে, না কোনো স্থায়ী পদ্ধতি গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকে একটি মহান উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি করেছেন। একইভাবে প্রত্যেক মানুষ জন্মের পর থেকে প্রয়োজনীয় অনুশীলন পায় এবং গড়ে ওঠে তার জীবন পদ্ধতি। ঠিক তেমনি তিনি মনে করতেন, সামরিক পোশাক পরিহিত অবস্থায় তাঁর দায়িত্ব হলো- দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা; রাষ্ট্র পরিচালনা করা নয়। এছাড়া ওই সময় দেশের প্রধান সমস্যা ছিলো- আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনা। তাই তিনি ১৯৭৫-এর ডিসেম্বরের পর থেকে সার্বিক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সংগে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। যতো দ্রুত সম্ভব দেশে গণতন্ত্রও ফিরিয়ে আনার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৭ সালে ‘হ্যাঁ-না’ ভোট এবং ১৯৭৮ সালে সরাসরি জনগণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অতঃপর ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।

শহীদ জিয়া বিশ্বাস করতেন, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। দেশের সকল কর্মকাণ্ডে জনগণের মতামত নেওয়া এবং সকল স্তরের নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই ছিলো তাঁর প্রধান লক্ষ্য। কারণ, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুখ বন্ধ রেখে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাঁদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করে, দেশের উন্নতি সাধন সম্ভব নয়। তাতে কেবল সাময়িক তৃপ্তিই পাওয়া যেতে পারে। তিনি মনে করতেন, জনগণের মত প্রকাশের অধিকার থাকতে হবে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে স্বাধীনভাবে তাঁর কর্তব্য পালনের সুযোগ দিতে হবে।

তিনি মনে করতেন, আয়তনে দেশ ছোট হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ বড় এবং বিশাল সম্ভাবনাময় একটি দেশ। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে এবং জনগণকে কাজে লাগাতে হবে। তাঁর ঐকান্তিক বিশ্বাস ও প্রয়াস ছিলো জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে দেশের ৬৮ হাজার গ্রামে কর্মচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনা। কঠোর পরিশ্রম, সততা এবং আন্তরিকতার মাধ্যমে দেশকে পৃথিবীর অন্য উন্নয়নশীল দেশের মতো গড়ে তোলা। বিশেষ করে খাল খনন, দ্বিগুণ খাদ্য ফলানো, গম চাষ-তুলা চাষের মাধ্যমে কৃষি বিপ্লব, পরিবার পরিকল্পনা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, শিল্প বিপ্লব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও মেহনতি মানুষের প্রতি ছিলো তাঁর আগাধ শ্রদ্ধাবোধ। তিনি তাঁর কর্মকাণ্ড ও কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য সুখী, সমৃদ্ধশালী ও সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন।

শহীদ জিয়া ছিলেন একজন করিৎকর্মা পুরুষ, স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ধারণার অধিকারী। ছিলেন অত্যন্ত চৌকস, প্রাজ্ঞ ও সুদক্ষ অফিসার এবং স্বল্পভাষী। যে কোনো পরিস্থিতিতে দ্রুত, সুপরিকল্পিত ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণে ছিলেন সক্ষম। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিলো অত্যন্ত প্রখর। অনেক সময় লক্ষ্য করেছি, ছোটখাটো বিষয়ও তিনি এড়িয়ে যেতেন না। যেমন- রাস্তায় ভিক্ষুক কোথায় দাঁড়াতো, পুলিশ কোথায় কীভাবে দায়িত্ব পালন করতো, কোথায় রাস্তা ভাঙা ইত্যাদি সবকিছু লক্ষ্য করতেন এবং বঙ্গভবনে পৌঁছানোর পর, ওসব সমস্যার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। যথাসময়ে তা কার্যকর হয়েছে কি না, তা-ও খোঁজ নিতেন। কখনও তাঁকে কোনো বিষয় ভুলতে দেখিনি।

তিনি ছিলেন একজন বিশাল হৃদয়ের অধিকারী এবং ভালো মনের মানুষ। অনেক সময় দেখেছি স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসার শিক্ষকরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানের জন্যে দু’/চার লক্ষ টাকা সাহায্যের জন্য তাঁর সংগে দেখা করতেন। তিনি জিজ্ঞাসা করতেন, ওই টাকা দিয়ে কী কী উন্নয়ন করা সম্ভব হবে, তা যেন ব্যাখ্যা করেন। এতে অনেকেই ভয় পেতেন এবং মনে করতেন, হয়তো তিনি বা তাঁরা বেশি টাকা দাবি করেছেন এবং রাষ্ট্রপতি তাঁর উপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাঁদের ব্যাখ্যা শোনার পর অনেক সময় দেখা যেতো, তিনি বলতেন, এতো অল্প টাকা দিয়ে কি ওই উন্নয়ন করা সম্ভব? আরও বেশি টাকা প্রয়োজন এবং সেই অনুযায়ী দরখাস্ত দেওয়ার পরামর্শ দিতেন।

তিনি বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুনভাবে সংস্কার, সুশৃঙ্খল, সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিলো বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী এবং আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। সকল স্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। তিনি ছিলেন একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহান রাষ্ট্রনায়ক, দেশপ্রেমিক, সাহসী, সৎ, চৌকষ এবং পারদর্শী নেতা। ১৯৮১ সালের ৩০ মে এই মহান নেতার ইন্তেকালে জাতি এক অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

লেখক: প্রেসিডেন্ট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর