বিশ্ব পানি দিবস আজ

পানির অপর নাম জীবন। এই স্বচ্ছ ও বর্ণহীন পদার্থ ছাড়া মানুষসহ যেকোনো প্রাণী ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজের জন্যও আমাদের পর্যাপ্ত পানি প্রয়োজন। আর প্রতিদিন জীবন বাঁচানোর পানি পান করতে হয়। সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে মানুষের প্রয়োজন নিরাপদ বিশুদ্ধ পানি। প্রায়ই পরামর্শ শোনা যায়, প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল মনে করেন, দৈনিক দুই থেকে সর্বোচ্চ আড়াই লিটার পানি করা প্রয়োজন। আমরা অফিস-আদালত, বাসা কিংবা হোটেলে যে পানি পান করি তা কতটুকু নিরাপদ এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। হোক সেটি জারের কিংবা বোতলজাত।

মালিবাগ মোড়ে একটি কলেজের ভেতর পানির ফ্যাক্টরি রয়েছে। যেখান থেকে প্রতিদিন দুই-আড়াই হাজার জারে পানি ভরে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। বাসা-বাড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন হোটেলে এই জারের পানি যায়। এই পানির ব্যবসার সঙ্গে যারা যুক্ত তারা মূলত ভ্যানে করে পানি সরবরাহ করে। প্রতিটি জারের পানির জন্য তারা ৪০-৫০ টাকা নেয়। আর এই পানি তারা কেনে জারপ্রতি ১০-১৫ টাকায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একজন জানিয়েছে, এই পানির ফ্যাক্টরির লাইসেন্সের জন্য বিএসটিআইয়ে আবেদন করা হয়েছে। এই ফ্যাক্টরিতে প্রবেশের কারণে মিডিয়াকর্মীদের অপমান হতে হয়েছে। দুয়েকবার বন্ধ করে দেওয়ার পরও এই ফ্যাক্টরি দিব্যি চলছে।

রাজধানীর কারওয়ানবাজারে মুরগির দোকানের পাশে হাসান মিয়ার চা-বিস্কুটের দোকান। ক্রেতাদের জন্য পানির জারও রয়েছে। প্রতি গ্যাস পানির দাম ১ টাকা। জারের গায়ে সাদা রঙে লেখা একজনের নাম। কিন্তু সেই পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়ের কোনো ধরনের সিল নেই।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা জারের পানি নিয়ে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল একটি গবেষণা করে। সে গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত ও হোটেলে সরবরাহ করা পানির মধ্যে অধিকমাত্রায় ক্ষতিকর জীবাণু রয়েছে। এই জীবাণু বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে। মানবদেহে দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া, মাথাব্যথা ও বমির মতো নানা ধরনের উপসর্গের দেখা মেলে বলে গবেষণার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ সরাসরি ওয়াসার সাপ্লাই করা পানিতে ফিটকিরি ও দুর্গন্ধ দূর করার ট্যাবলেট মিশিয়ে জারে পানি ভরছে। আর সেই জারের পানি বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করছে। এই পানি ব্যবসার সঙ্গে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা শহরের অলিগলিতে জারের পানি সরবরাহ করা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। অনেকের বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স নেই। অনেকের মধ্যে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অকপটে স্বীকার করেন, লাইসেন্স করার জন্য আবেদন করা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও লাইসেন্স থাকলেও শর্ত অনুযায়ী পানি পরীক্ষা করা হয় না। জারের গায়ে খনিজ উপাদানের উপস্থিতি সম্পর্কে কোনো লেবেল থাকে না। ফলে পানির গুণগত মানের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

সম্প্রতি কারওয়ানবাজারের কলাপট্টি এলাকায় পিওর ড্রিঙ্কিং ওয়াটার নামে একটি কারখানার ভেতরে নোংরা পরিবেশে দুজন শ্রমিককে ডিটারজেন্ট দিয়ে জার পরিষ্কার করতে দেখা গেছে। তাদের কারখানায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি শোধন করা হয়। এসব পানি আশপাশের চায়ের দোকান ও হোটেলে যায়।

বিএসটিআইয়ের এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের খোলাবাজারে বিক্রি হয় এমন পাঁচটি ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি মানসম্মত নয়। এটি স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

জনস্বার্থে করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোটের নির্দেশ অনুযায়ী ১৫টি কোম্পানির বোতলজাত পানি পরীক্ষা করে বিএসটিআই এ তথ্য জানতে পারে। তারা পানির রঙ, স্বাদ, পিএইচ ভ্যালু, ক্যালসিয়াম ও ক্যাডিয়ামসহ বিভিন্ন উপাদানের পরীক্ষা করে।

আরেক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোনো কোনো বোতলজাত পানিতে রয়েছে প্লাস্টিকের কণা, যা শরীরে নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। শুধু তাই নয়, এটি নারীর বন্ধ্যত্বের কারণও হতে পারে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল বোতলজাত ও জারের পানির ওপর একটি গবেষণা করে। সেই গবেষণায় পানিতে বিদ্যমান খনিজ উপাদানের মাত্রা ও গুণাগুণের বিষয়ে ৩৫টি ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি ও ২৫০টি জারের পানির নমুনা সংগ্রহ করে তারা। পরীক্ষায় প্রায় সব জারের পানিই দূষিত বলে প্রমাণিত হয়। গবেষণায় বলা হয়েছে, ১শ’ মিলি জারের পানির নমুনায় ১-১৬০০ এমপিএনের বেশি কলি পাওয়া গেছে। যেখানে বিএসটিআইয়ের মান অনুযায়ী শূন্য কলি থাকা উচিত।

এ বিষয়ে বিএসটিআইয়ের উপ-পরিচালক মো. রেজাউল হক জানান, জারের পানি আর বোতলের পানির ওপর আমাদের নজরদারি আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। চলতি মার্চ মাসে ৩৩টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে ৩৬টি প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। ৩৩ হাজার ৫শ’ নোংরা পানির জার ধ্বংস করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

তিনি জানান, আমরা ইতোমধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিয়েছি। এরপরও ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছে। আর বোতলজাত পানির ক্ষেত্রেও বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডের পানির লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। বাজার থেকে এনে নমুনা পরীক্ষা করছি। যেখানেই অনিয়ম দেখছি, সেখানেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, স্বল্প বা বিনা পুঁজিতে লাভজনক এই ব্যবসায় জড়িয়েছেন ক্ষমতাবান বিভিন্ন শ্রেণির নেতা। আর তারাই এলাকাভিত্তিক এসব জারের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ কারণে বিএসটিআই অভিযান চালাতে গিয়ে অনেক সময় বেকায়দায় পড়ে যায়।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর