‘বোনাস লাইফ নিয়ে ত্রিশ বছর’ মনে পড়ে বিভীষিকাময় সেই রাতের কথা

আমার জীবনটা শেষ হয়ে যেতে পারতো সেই ত্রিশ বছর আগেই। সেই ভয়াল কালো রাতটিতে খুব কাছে থেকেই দেখেছিলাম মৃত্যুকে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের সেই রাতে ছেড়েই দিয়েছিলাম পৃথিবীর মায়া। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় রাতভর ঝড়-জলোচ্ছাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে গিয়েছিলাম-অনেকটা বোনাস লাইফের মতো। আর সেই বোনাস লাইফ নিয়েই কেটে গেছে ত্রিশ বছর।

বলছি, আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা। চোখ বুঝলে এখনো কল্পনায় স্পষ্ট দেখতে পাই বিভীষিকাময় রাতটির স্মৃতিগুলো। মনে পড়ে সেই রাতে হারিয়ে ফেলা স্বজনদের কথা।
আমি তখন সদ্য ভর্তি হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকতাম শহরের পূর্ব মাদারবাড়ি বড় ভাইয়ের সাথে। ঘূর্ণিঝড়ের ঠিক আগের দিন শহর থেকে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর গ্রামে আমাদের বাড়িতে। বাড়ি থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর আর আড়াই কিলোমিটার দক্ষিন পূর্বে ছিল শংখ নদী।

দিনটি ছিল সোমবার। সকাল থেকেই আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। হালকা বাতাস বইছিল। গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল তবু ভ্যাপসা গরম কাটছিলনা। দুপুরের পর থেকে আবহাওয়ার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। ক্রমশ বাড়ছিল বাতাসের গতি। দু’দিন আগেই নিম্নচাপের সংকেত দিয়েছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয় আগের রাতেই। সেই রাতেই সম্ভাব্য বিপদের পূর্বাভাষ জানানো হয় আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে। সোমবার বিকেল ৫টার পর থেকে বেড়ে যায় বাতাসের গতি, একই সঙ্গে বৃষ্টিও। সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসার পর শুরু হয় ঝড়ো হাওয়ার ঝাপটা। মাঝে মধ্যে দমকা হাওয়া বইছিল। মনে হচ্ছিল যেন টিনের চালা খুলে নিয়ে যাচ্ছে।
মাটির দেয়াল আর উপরে টিন শেট দেয়া ঘরে ছিলাম আমি, মা ও ভাগিনী বিলকিস। এ অবস্থার মধ্যেই আম্মা রান্নাবান্না শেষ করে ফেলেন। কিন্তু খাইনি কেউই। রাত ৯টার দিকে জেঠাত ভাই আবুল কালাম বৃষ্টির মধ্যে এসে আম্মাকে জানালেন ১০নম্বর বিপদ সংকেতের কথা। বললেন, সাইক্লোন শেল্টার কিংবা দূরে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু আম্মা রাজি হলেন না। বললেন- বিল খাল শুকনো। পানি আসলে তা তো জমিই চুষে নেবে। বাড়ির অনেকেই এসময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেও আমরা সহ বাড়ির ১১টি পরিবারের বাকী সদস্যরা থেকে গেলাম নিজ নিজ ঘরে। বাইরে প্রচন্ড গতিতে বইছিল ঝড়। ঝড়ো হাওয়া আর বর্ষণের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিলনা তখন। মনে মনে ভয় লাগলেও ভরসা দিচ্ছিলেন আম্মা। হারিকেন জালিয়ে একটি রুমে এসে বসে রইলাম আমরা তিনজন। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল দমকা হাওয়া আমাদের ঘরটিই হয়ত: উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

রাত বারোটার দিকে জানালা ফাঁক করে বাইরে টর্চ লাইটের আলো ফেলতেই দেখি ঘরের দেয়ালের কাছেই পানি। তড়ি ঘড়ি করে আম্মা আর ভাগিনীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। আমার ডাকাডাকিতে ৫বছরের পুত্র বাদশা আর ৩বছরের মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে এলো জেঠাত ভাই ফয়েজ ও তাঁর স্ত্রী। এলেন জেঠাত বোন আয়েশা, তাঁর স্বামী সত্তরোর্ধ আছদ আলী ও মেয়ে ফাতেমা। বাড়ির উঠোনে তখন কোমর সমান পানি। সবাই মিলে পানি ভেঙ্গে ভিটের উত্তর পূর্ব পাশে থাকা খড়ের গাদায় গিয়ে উঠলাম। প্রথম দফায় শংখের বাঁধ বিলীন হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব থেকে ধেয়ে আসা পানি দ্রুত বাড়ছিল তখন। এ অবস্থায় আমরা একে অপরকে ধরে একসঙ্গে জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলাম । কিন্তু বেশিক্ষন টিকে থাকতে পারিনি। রাত সাড়ে ১২টায় দ্বিতীয় দফায় বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা জলোচ্ছাসের ঢেউয়ের আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে ছিড়ে যায় খড়ের গাদাটি। আমার চোখের সামনেই অল্প খড় সহ বিচ্ছিন্ন হয়ে ভেসে গেলেন আম্মা ও ভাগিনী বিলকিস। তাঁদের ধরে রাখার কোন চেষ্ঠাই কাজে আসল না। একই ভাবে একে একে ভেসে গেলেন আয়েশা ও তাঁর স্বামী আছদ আলী। ছেলে বাদশা আর মেয়ে মুন্নীকে কাঁধে নিয়ে খড় ধরে ভেসে গেলেন জেঠাত ভাই ফয়েজ। বাকী রইলাম আমি, ফয়েজের স্ত্রী ও ফাতেমা।
প্রাণের মায়া তখনো ছাড়িনি। হঠাৎ দক্ষিণ দিক থেকে একটি খালি চালা এসে ঠেকল খড়ের গাদা ও পাশ্ববর্তী ফুল গাছের সঙ্গে। আমরা তিনজনই তাতে উঠে পড়লাম। দশ মিনিটের মতো ওই অবস্থায় ছিলাম। এরপর হঠাৎ পানির প্রচন্ড স্রােত আমাদের সহ চালাটি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগল পূর্ব দিকে। প্রায় আধ কিলোমিটার যাবার পর চালা থেকে ছিটকে পড়ে গেলাম আমি। মনে হলো এখানেই জীবন শেষ, বাঁচার আশা প্রায় ছেড়ে দিলাম। এমন সময় হঠাৎ ভেসে উঠলাম পানির উপরে। ঝড়ে ডাল পালা ভেঙ্গে গিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে থাকা একটা কড়ই গাছ পেলাম সামনে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম গাছটি। এক একটি ঢেউ এসে চলে যাচ্ছিল মাথার উপর দিয়ে। গাছটি জড়িয়ে ধরে ঢেউয়ের ধাক্কার মুখে অনেক কষ্টে নিজেকে টিকিয়ে রাখছিলাম। ঢেউ যাবার পর মাথাটা কোনভাবে পানির উপরে তুলে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। গাছটির ডালপালা না থাকায় উপরে উঠারও কোন সুযোগ ছিলনা।

তখন গভীর রাত। পানির নিচে ডুবে গেছে পুরো উপকূলীয় এলাকা। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। মনে হচ্ছিল যেন সাগর মাঝে ভাসছি আমি। ঘরের চালা, গাছ পালা, খড় কুটো ইত্যাদি স্রােতের টানে চলে যাচ্ছিল আমার কাছ দিয়েই। পানিতে ভাসতে থাকা এক মহিলাকে দেখলাম ঘোঙাতে ঘোঙাতে এসে ঠেকেছে একটু দূরে আরেকটি গাছের সঙ্গে। কিন্তু এ সময় গাছটি ধরে বাঁচার চেষ্ঠা করার মত শক্তিও সম্ভবত: তার ছিলনা। কিছুক্ষণ পরে সেখানেই তাকে নিথর হয়ে ভাসতে দেখলাম। এভাবে অনেক আদম সন্তানের লাশ ভেসে যেতে দেখেছি খুব কাছে থেকে। এভাবে ঝড় আর ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করেই কাটে সারারাত।

রাত অনুমান তিনটার পর থেকে পনি কমতে শুরু করে। পানি কমে যাওয়ার পর সকাল ৭টার সময় নেমে আসি রাতভর বুকে জড়িয়ে রাখা গাছটি থেকে। তখনো বুক সমান পানি। পানি সাতরে কোন ভাবে উঠে এলাম বাড়ির সামনের রাস্তায়। এ সময় রাস্তার দু’পাশে দেখা যাচ্ছিল কেবল লাশ আর লাশ। চিৎ, কাত, উপুড় হয়ে পড়ে থাকা বিবস্ত্র নারী পুরুষের লাশ, সন্তান বুকে মায়ের লাশ, গরু ছাগলের অসংখ্য মরদেহ। চোখের সামনে ভেসে যাওয়া আম্মা-ভাগিনী, প্রতিবেশি কারো বেঁচে থাকার আশাই করতে পারছিলাম না তখন।
ভিটেতে ফিরে দেখি ঘরের কোন অস্তিত্ব নেই। শূণ্য ভিটেয় ভেজা কাপড়ে বসে কাঁদছেন আম্মা। তিনি জানালেন, খড়সহ ভেসে যাবার পথে একটি গাছ ধরে রাতভর মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচেছিলেন তিনি। একই ভাবে বেঁচে যান ভাগিনী বিলকিসও। কিন্তু চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় জেঠাত ভাই ফয়েজ, তার ছেলে বাদশা ও মেয়ে সহ আমাদের বাড়ির তিনটি পরিবারের ১৬জন সদস্য। অনেক খোঁজাখুঁজির পর মিলেনি এদের অনেকের লাশের সন্ধান।

আমার জীবনটাও থেমে যেতে পারতো সেই রাতটিতেই। আরো অনেকের মতো রাস্তার ধারে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকতে পারতাম। হাজারো লাশের মধ্যে হয়ত হয়ত মিলতনা আমার পরিচয়ও।
মহান আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করি- তাঁর কৃপায় এখনো বেঁচে আছি বলে।

লেখক: ম. শামসুল ইসলাম
সাধারণ সম্পাদক
চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন।

সুমন শাহ্/বার্তাবাজার/ভিএস

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর