নিজের জমানো ৩০০ টাকায় আজ লাখপতি

জীবন সুন্দর, তার চেয়ে বেশি সুন্দর জীবনের স্বপ্নগুলো। জীবন থেমে থাকার জন্য নয়। হতাশা, ক্রোধকে ভুলে কঠোর পরিশ্রম, মেধা ও অনুপ্রেরণা দিয়ে যে জীবনকে জয় করা সম্ভব, তার একজন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শামীমা সুলতানা। নিজের স্বামী ও এক মেয়েকে ঠিক যতটুকু সময় দেন, তার চেয়ে বেশি সময় দেন নিজের ফেসবুক ভিত্তিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আনকোরা। এক কন্যা সন্তানের মা অনার্স শেষ না হতেই যখন চাকরির আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরতে গিয়ে নিজের মধ্যে হতাশা আবিষ্কার করলেন, ঠিক তখনই ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন মাথায় চাপে।

এরপর স্বামীর অনুপ্রেরণায় নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুললেন। ‘আনকোরা’ ফেসবুক পেজ তার জীবনকে নিয়ে গেলো এক অনন্য উচ্চতায়। নিজের জমানো মাত্র ৩০০ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করে বর্তমানে প্রায় ১,০০,৫৩০ লাখেরও বেশি টাকার পুঁজি করেছেন। প্রতি মাসে আয় করছেন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এমনটাই জানান নবীন ‘আনকোরা’ স্বত্বাধিকারী শামীমা সুলতানা। বলছিলাম টাঙ্গাইলের মেয়ে শামীমা সুলতানার কথা।

এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাকে। কিন্তু সংসার ও সন্তান লালন-পালনের পাশাপাশি সফলতার সঙ্গে চালিয়ে যান পড়াশোনা। শামীমা সুলতানা টাঙ্গাইলের কুমুদিনী সরকারি মহিলা কলেজের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী। চাকরির আশায় বসে না থেকে শামীমা সুলতানা উইয়ের মাধ্যমে শুরু করেছেন অনলাইন ব্যবসা। ‘আনাকোরা’ নামে ফেসবুক পেজ খুলে দেশীয় আমসত্ত্ব বিভিন্ন রকমের আচার ফেসবুক পেইজে আপলোড দিতে থাকেন। ধীরে ধীরে অর্ডার আসতে থাকে। সেই সঙ্গে মানুষের চাহিদাও বাড়তে থাকে; ফলে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে ‘আনাকোরা’ পেজ।

শামীমা সুলতানা বার্তা বাজারকে বলেন, গত বছর সারা বিশ্বে যখন মহামারী শুরু, তখন আমাদের দেশও মহামারী থেকে রক্ষা পায়নি। গতবছর ১৭ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয় সরকার। তখন ঘরবন্দী হয়ে যাই। তারপর থেকে মনে মনে চিন্তা করি কিছু একটা করতে হবে। আমি উই নামের একটা ফেসবুক পেজ দেখতে পাই। আমারও ইচ্ছে জাগলো এই অলস সময়টা নষ্ট না করে সময়টাকে কাজে লাগাই। তারপর থেকেই শুরু করি অনলাইনে ব্যবসা । আচার, আমসত্ত্বা ও বিভিন্ন হ্যান্ডপেন্ড নিয়ে কাজ শুরু করি। আস্তে আস্তে শুরু হলো আমার অর্ডার আসা। মেয়ে নয় মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয় গড়াই ছিলো আসল উদ্দ্যেশ্য। উই থেকে আমার উদ্যোক্তা জীবনের শুরু। উই থেকেই শিখেছি কিভাবে ঘরে বাহিরে সব কিছু সামলিয়ে নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সফল উদ্যেক্তা হওয়া যায়! তবে ডিএসবির অবদানও কিন্তু অস্বীকার করার মতন না!

বার্তা বাজার: কেনো মনে হলো, আপনি উদ্যোক্তা হবেন?
শামীমা: কম বয়সে বিয়ে, পড়াশোনা, সংসার আর একমাত্র মেয়ের জন্মের পর পরই মনে হলো মেয়ের মা হিসেবে একটা পরিচয় আমার ভীষণ প্রয়োজন। কিছু একটা আমাকে করতেই হবে সেই ভাবনা থেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা এসেছে মাথায়।
বার্তা বাজার: আপনার লাখপতি হওয়ার গল্পটা শুনতে চাই।

শামীমা: লাখপতি হওয়ার গল্পটা যত সহজে বলবো ততটাও সহজ ছিলো না! আসলে শুধুমাত্র আচার নিয়ে কেউ লাখপতি হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই! উদ্যোক্তা শুরুর দিকে বেশ ভালো সাড়া পেলেও সেটা সময়ের সাথে সাথে কমে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই নভেম্বর মাসের দিকে ডিএসবিতে রাজীব স্যারের পোস্ট দেখে নিজেকে আরও দক্ষ করার যাত্রা শুরু হয়! উদ্যোক্তা হওয়ার ৫ মাস পরে আবার নতুন ভাবে উদ্যোক্তা হলাম। আর উইতে তখন থেকেই এক্টিভিটি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম! সেলটা মূলত তখন থেকেই শুরু আর ৫ মাসের ব্যবধানে শুধু আচার সেল করেই লাখপতি হয়ে গেলাম।

বার্তা বাজার: আপনার মাসে আয় কত?
শামীমা: আমার মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা আয় হয়।
বার্তা বাজার: আপনার ব্যবসা পদ্ধতি কি?
শামীমা: আমার ব্যবসা পদ্ধতি মূলত অনলাইন ভিত্তিক। তবে এখন সময় আর পরিচিতির সাথে সাথে অফলাইনেও টুকটাক সেল হয়।

বার্তা বাজার: শুরুর চ্যালেঞ্জগুলো কি কি ছিল (বিনিয়োগ, সহযোগিতা ইত্যাদি) কিভাবে মোকাবেলা করেছেন?
শামীমা: আমার কাজ মূলত আচার, আমসত্ত্ব নিয়ে। শুরুর দিকে নিজ এরিয়ার বাইরে কুরিয়ারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে যেহেতু ফুড আইটেম! প্যাকেজিং নিয়েও বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে! তবে পরবর্তীতে এই প্যাকেজিং নিয়েই বেশ প্রশংসা পেরেছি। আমার জমানো ৩০০ টাকা দিয়েই শুরু হয়েছিলো আমার আনকোরার যাত্রা! যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব ছিলো তাই রিস্ক বা স্টক করার ব্যাপারে কিছুটা ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে! সেরকম ভাবে কোন আর্থিক সহায়তা পাইনি কারো থেকে আসলে নিতে ইচ্ছে হয়নি আমার। আমার ব্যবসাতে আমি অন্য কারো থেকে এক টাকাও সহায়তাও নেইনি ! আমি মানসিক সাপোর্টের দিক থেকে অনেক ভাগ্যবান, আমার স্বামী ছাড়াও বন্ধু বান্ধব, আশেপাশের মানুষের থেকে পেয়েছি প্রচুর সাপোর্ট যেটা কিনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ পায় না!

বার্তা বাজার: আপনার সফলতার পিছনে কোনটার প্রভাব ছিলো?
শামীমা: আমার সফলতার পেছনে আমি মনে করি উই আর ডিএসবির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। কেননা আমার উদ্যেক্তা জীবনের শুরু, সফলতা বা বিজনেস রিলেটেড সবকিছু পেয়েছি উই আর ডিএসবি থেকে।

বার্তা বাজার: আজকে আপনি যতখানি সফল তার পিছনে উল্লেখযোগ্য কারনগুলা কি? শামীমা: কাজের মধ্যে ধৈর্য ধরে লেগে থাকা, সততা, পরিশ্রম, দায়িত্বে কোন রকম অবহেলা না। আমাকে সর্বোচ্চ সাপোর্ট দেন আমার হাসবেন্ড। আমার সফলতার পিছনে তার এই সাপোর্টটা যথেষ্ট পরিমাণে গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে!

বার্তা বাজার: অনলাইনে ব্যবসা তাও আবার ফুড আইটেম, সম্ভাবনা কেমন?
শামীমা: আমি কাজ করতে যেয়ে বুঝেছি মানুষ কোয়ালিটিতে বিশ্বাসী আর হোমমেড খাবার মানুষ নিশ্চিত মনে গ্রহন করতে আগ্রহী! আমি নিজে যে খাবারটা খাচ্ছি বা আমার পরিবারকে দিচ্ছি সেই খাবারটাই আমি আমার ক্রেতাকে দিচ্ছি মানে আমার ভালোটাই দিচ্ছি। কুরিয়ার ব্যবস্থা যত উন্নত করা যাবে ফুড আইটেম নিয়ে দ্রুত আগানো যাবে। মানুষের কাছেও সাড়া পাওয়া যাবে।

বার্তা বাজার: আপনার কাজ নিয়ে ভবিষ্যতে পরিকল্পনা কি?
শামীমা: আমার আনকোরাকে ব্র‍্যান্ড হিসেবে দেখতে চাই। বাংলাদেশের প্রাণ,রুচির চেয়েও ভালো অবস্থানে থাকবে আনকোরা। আনকোরার মাধ্যমেই যেন আমার মতন আরো মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারি সেই পরিকল্পনা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি। অতি দ্রুতই বাস্তবায়ন করবো।

বার্তা বাজার: উদ্যোক্তাদের সফলতার সাথে সাথে যে বিষয়গুলো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, তার মধ্যে উদ্যোক্তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন অন্যতম। আপনার ক্ষেত্রে বিষয়টি কি?
শামীমা: আমি ব্যক্তিগত ভাবে তেমন বাধা পাইনি শুধুমাত্র আমার বাবা ছাড়া! তারপরও নিজের লক্ষ্য স্থির রেখে চেষ্টা করে গেছি। এখন কিছুটা হলেও সফলতা পেয়েছি। সামাজিক ভাবে মেয়ে বা নারী হিসেবে প্রতিটা জায়গায় বাধা পেয়েছি। আমার ব্যবসার সব কাজ গুলো আমি নিজেই করি। বাজার থেকে শুরু করে কুরিয়ার পর্যন্ত। মেয়ে মানুষ বাজারে যাবে বাহিরে যাবে এ বিষয় নিয়ে এখনও কথা শুনতে হয়! আসলে এই বিষয়টা একদমই কমন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে। তবে সব বাধা পেরিয়ে যে ধৈর্য ধরে থাকতে পারে বিজয়ীর হাসিটা সেই হাসতে পারে! আর আমি প্রতিনিয়ত সেই ধৈর্য নিয়েই থাকি।

বার্তা বাজার: আপনার পরিবার সম্পর্কে বলেন।
শামীমা: আমার বাবা বিজিবির কর্মকর্তা ছিলেন, মা গৃহিণী। দুই বোনের মধ্যে আমিই ছোট। সবার কাছে আমি বেশ আদরের ছিলাম। বিয়ে হওয়ার পর শ্বশুড় বাড়িতেও আমি সবার ছোট বউ, সেখানেও বেশ আদরের! তবে ব্যক্তিগত জীবনে আমি এক মেয়ের মা আর আমার হাসবেন্ড একজন চাকুরীজিবী। এইতো আমার পরিবার।

বার্তা বাজার: আপনার পড়াশোনা..
শামীমা: ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি অন্য সাইটগুলোতেও বেশ ভালো ছিলাম। কখনো ডাক্তার কখনো ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়ে শেষ পর্যন্ত আমার পড়াশোনা বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে (অনার্স ফাইনাল ইয়ারে) কুমুদিনী সরকারি কলেজে। আগে বেশ খারাপ লাগতো পাব্লিকেও পড়তে পারিনি তবে এখন আর এগুলো নিয়ে আফসোস নেই! এখানে একটা কথা না বললেই নয় অনেকেই ভাবেন পড়াশোনাতে খারাপ বা জীবনে কিছু করতে না পারা মানুষেরাই উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীর পথ খুজে নেয়! সেদিক দিয়ে কিন্তু আমি একাডেমিক পড়াশোনাতে বেশ এগিয়ে! পদার্থবিজ্ঞানের মতন বিষয় নিয়ে পড়েও আমার রেজাল্ট কিন্তু বরাবরই ফার্স্ট ক্লাস।
বার্তা বাজার: যে সাফল্যের কথা আপনি সবাইকে বলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন…
শামীমা: আমি পড়াশোনা করি, বাচ্চা সামলাই, সংসার সামলাই আবার আমার উদ্যোগের কাজ সবটাই একা হাতে সামলাই। পড়াশোনা শেষ করার আগেই নিজের একটা পরিচয় গড়তে পেরেছি। এটাই আমার সফলতা আমি মনে করি আর বেশ ভালোও লাগে বলতে! যারা বাচ্চা, সংসার,পড়াশোনাকে অযুহাত দেখান তাদের জন্য অনুপ্রেরণা শুধু আমিই!

বার্তা বাজার: নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য শুরু করতে বিনিয়োগ কতখানি সমস্যা বলে আপনি মনে করেন?
শামীমা: নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য শুরু করতে বিনিয়োগ খুব একটা সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয় না। কেননা নিজের জমানো টাকা বা টিউশন ফি অথবা নিজের পরিবারের থেকে নিয়েও শুরু করা যায়। শুধু একটু মাথা খাটিয়ে চললেই অল্প টাকা নিয়েও শুরু করতে পারবেন!

বার্তা বাজার: নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য কি বলতে চান?
শামীমা: নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দ্যেশ্য বলতে চাই ব্যবসা করতে গেলে ধৈর্য, পরিশ্রম, সততা আর নিয়মিত লেগে থাকতে হবে। কোন পরিস্থিতিতেই হাল ছাড়া যাবে না। ব্যবসায় লাভ লস থাকবেই তারপরও চালিয়ে নিতে হবে। আর হুজুগে উদ্যোক্তা হওয়া উচিৎ না। শখের বশে উদ্যোক্তা হয়ে ভুল প্রাইসিং করে মার্কেট নষ্ট করবেন না! আপনার কাছে শখের উদ্যোক্তা কিন্তু অন্যজনের কাছে তা জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম।

বার্তা বাজার: .আপনি কি কি আইটেম নিয়ে কাজ করেন?
শামীমা: আমি কাজ করি হোমমেড আচার, আমসত্ত্ব, হ্যান্ডপেইন্ট পোশাক নিয়ে। আমার সিগনেচার আইটেম আচারি শুটকি। স্বত্বাধিকারী -আনকোরা।

হাসান সিকদার/বার্তাবাজার/পি

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর