৯ ঘণ্টা রিকশা চালিয়ে সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে বাবা!

দীর্ঘ ৯ ঘণ্টা রিকশা চালিয়ে ১১০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ঠাকুরগাঁও থেকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অসুস্থ শিশু সন্তানকে নিয়ে এসেছেন তারেক ইসলাম নামে এক বাবা। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় তারেক ইসলাম তার সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

তারেকের সাথে কথা হলে তিনি বলেন শনিবার (১৭ এপ্রিল) সকালে দিকে বাসা থেকে বের হয়ে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়ে বেলা সোয়া তিনটায় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসে পৌঁছান। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বারবার হু-হু করে কাঁদতে থাকেন তারেক।

৭ মাসের শিশু জান্নাতের পেটের নাড় উল্টে যাওয়াতে গত ১৩ এপ্রিল রাতে গুরুত্বর অসুস্থ অবস্থায় ঠাকুঁরগাও সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

পরে চিকিৎসক একদিন দেখার পর জান্নাতকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিক্যাল কলেজে রেফার্ড করেন। সারাদেশে লকডাউন থাকায় অ্যাম্বুলেন্সের দ্বিগুণ ভাড়া যোগাতে ব্যর্থ হন তারেক। কোনো উপায় না পেয়ে অবশেষে নিজে রিকশা চালিয়ে সন্তানকে রংপুরে নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করান।

শনিবার (১৭ এপ্রিল) বিকেল সোয়া তিনটার দিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে সন্তানকে কোলে নিয়ে ছুটোছুটি করতে দেখা যায় বাবা তারেক ইসলামকে। তার সঙ্গে থাকা অন্য স্বজনদের চোখে মুখে তখন দীর্ঘ নয় ঘণ্টা রিকশায় চড়ে আসার ক্লান্তির ছাপ।

তারেকের সাথে কথা হলে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন, তিনি বলেন লকডাউনের কারণে অসুস্থ শিশু জান্নাতকে কষ্ট করে রংপুরে নিয়ে এসেছি। আমি রিকশা চালাই, অ্যাম্বুলেন্সে করে বাচ্চাকে নিয়ে আসার মতো আমার সামর্থ্য নেই। চারদিন আগেই ডাক্তার বাচ্চাকে রংপুরে নেয়ার জন্য বলেছিল। আমি যে বাচ্চাকে রংপুর নিয়ে আসব এরজন্য আমর কাছে কোনো টাকা ছিলো না। প্রথমে বাচ্চাকে ডাক্তার দেখানো ও ঠাঁকুরগাও সদর হাসপাতালে ভর্তি করানোর সময় অন্যের কাছ থেকে পাঁচশ টাকা ধার করে নিয়েছিলাম। এরপর থেকে আমি কোনো দিশা পাচ্ছিলাম না।

তিনি আরও বলেন, সকাল ছয়টার দিকে আল্লাহর নাম দিয়ে বাসা থেকে বের হই। রাস্তায় আসতে আসতে তারাগঞ্জের দিকে এসে রিকশার চার্জ শেষ হয়ে যায়। পরে এক অটোচালক বাচ্চার সমস্যার কথা জেনে আমাকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছার জন্য বাধ্য হয়ে দুই-তিন কিলোমিটার রাস্তা রিকশাটা ঠেলে নিয়ে আসি। পথিমধ্যে আরেকটা গাড়ি আমাকে মেডিকেল পৌঁছানোর জন্য সহযোগিতা করেন। প্রায় নয় ঘণ্টা পর বাচ্চাকে নিয়ে হাসপাতালে এসে পৌঁছেছি।

অসহায় বাবা তারেক আর ও বলেন, শুক্রবার (১৬ এপ্রিল) রাতে ঠাঁকুরগাও সদর হাসপাতাল থেকে রাতে বাচ্চাকে নিয়ে বাসায় যাই। বাচ্চার কন্ডিশন দেখে আমি চিন্তিত। কিন্তু লকডাউনোর কারণে আমার অবস্থা এতোই খারাপ যে কালকে কি খাব, সেই টাকাও আমার কাছে নেই। এ অবস্থায় আমি কিভাবে বাচ্চাটাকে নিয়ে এতোদূরের রাস্তা আসব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। যখন অ্যাম্বুলেন্সের টাকা জোগাড় করতে পারলাম না। তখন সন্তানকে বাঁচানোর জন্য রিকশা চালিয়ে রংপুরে আসার সিদ্ধান্ত নেই।

জরুরি বিভাগ থেকে ভর্তির রশিদ নিয়ে দ্রুত হাসপাতালের পাঁচতলার শিশু বিভাগে (১৮ নং ওয়ার্ড) শিশু জান্নাতকে নেয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক দেখার পর কিছু ওষুধ ও স্যালাইন দিয়েছেন। আজকের পর্যবেক্ষণ শেষে অপারেশন করা লাগতে পারে বলে চিকিৎসকের উদ্ধৃতি কথা জানান তারেক ইসলাম। কিন্তু অপারেশন করার মতো টাকা তার কাছে নেই। এমনকি চিকিৎসকের লিখে দেওয়া প্রাথমিক পর্যায়ের ওষুধ, স্যালাইন, ইঞ্জেকশন কেনার জন্য একশ টাকাও নেই। এখন আমি কি করব আল্লাহ ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না- এসব কথা যোগ করেন তারেক।

ঠাঁকুরগাও সদর উপজেলার দক্ষিণ সালন্দর গ্রামের রামবাবুর গোডাউন এলাকার আনোয়ার হোসেনের বড় ছেলে তারেক ইসলাম। তিনি বারো বছর বয়সেই রিকশা প্যাডেল ঘুরিয়ে বাবার সংসারের বোঝা সামলানোর যুদ্ধ শুরু করেন। নিজে বিয়ের পর স্ত্রী সুলতানা বেগমকে নিয়ে আলাদা থাকা শুরু করে। সংসার জীবনে তার নয় বছর ও তিন বছর বয়সী আরও দুই মেয়ে সন্তান রয়েছে। তারেক রিকশা চালানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ওয়াজ মাহফিলে সাউন্ড সিস্টেম অপারেটর হিসেবে কাজ করত। কিন্তু করোনার মহামারি শুরুর পর থেকে অনুষ্ঠান না থাকায় তার বাড়তি আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে লকডাউন পরিস্থিতিতে ঠিক মতো রিকশা চালাতে না পেরে অসহনীয় কষ্ট নেমে এসেছে তার পরিবারে।

অসহায় রিকশাচালক তারেক ইসলাম তার অসুস্থ শিশু জান্নাতকে বাঁচানোর জন্য সমাজের বৃত্তবান ও দানশীল মানুষদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমার তো সামর্থ্য নেই বাচ্চার অপারেশন করাবো। যদি সমাজের বৃত্তবান মানুষেরা এগিয়ে আসে আমি জান্নাতকে বাঁচাতে পারব। বাচ্চার হাসিমাখা মুখটা দেখতে পারব। আল্লাহর অশেষ করুণা আর সবার সহযোগিতা ছাড়া আমার কোনো পথ নেই।

শিশু জান্নাতের চিকিৎসার জন্য সাহায্য ও যোগাযোগ করতে চাইলে এই নম্বরে যোগাযোগ করুন ০১৩২০৫৪১১০৩। বর্তমানে শিশুটি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগে (১৮ নং ওয়ার্ড) চিকিৎসাধীন রয়েছে।

রকি আহমেদ/বার্তাবাজার/ই.এইচ.এম

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর