শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ মুনশী রইসউদ্দিনের ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী
উপমহাদেশের প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ মুনশী রইসউদ্দিনের আজ ৪৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৩ সালের ১১ এপ্রিল তিনি ত্যাগ করেন ইহলোকের মায়া। ছদ্মনামে আলম পিয়া হিসেবে পরিচিত এই মনীষী উপমহাদেশে জন্ম দিয়ে গেছেন গুনী অনেক সংগীত শিল্পীকে। শিল্পকে তিনি শিল্পীদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন।
ভারতীয় সংগীতশিল্পী ইলা বসু, শিপ্রা দাস, বাংলাদেশের সংগীত সাধক ও গবেষক ড. সনজিদা খাতুন, সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান, ওস্তাদ বেদার উদ্দিন আহমেদ, সংগীতশিল্পী মিলিয়া আলী ও লতিফা চৌধুরী প্রমুখসহ বিভিন্ন খ্যাতিমান শিল্পী তার কাছ থেকে শিক্ষালাভ করে এখন আলো ছড়াচ্ছেন বিশ্বময়।
১৯০১ সালের ১০ জানুয়ারি মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার নাকোল গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন এই কীর্তিমান পুরুষ। ১৯১৭ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সেই ম্যাট্রিক পাশ করার পর পারিবারিক বন্ধন ছেড়ে শুধু সংগীত শেখার টানে তিনি ছুটে যান কোলকাতায়।
সেখানে প্রখ্যাত সাধকদের সান্নিধ্য লাভ করেন। সংগীতকলা ভবনে ভর্তি হয়ে উচ্চাঙ্গসংগীতে সার্টিফিকেট লাভ করেন। পরবর্তীতে আর্থিক সংকটের জন্য কলকাতায় সংগীত শিক্ষাজীবন বাধা পায়। কিন্তু সকল সংকট উৎরিয়ে কলকাতার ‘ওয়েলম্যান স্টোরে’ সাতাশ টাকা বেতনে সেল্সম্যানের কাজ শুরু করেন তিনি। তবে কিছুকাল পরেই তিনি তাঁর বাবার ডাকে গ্রামেরবাড়িতে ফিরে আসেন।
যৌবনে মুনশী রইসউদ্দিন প্রথমে কুষ্টিয়া মিলে চাকরি করেন। সংগীত শিক্ষা প্রসারের জন্য ঐ সময় তিনি কুষ্টিয়ায় সংগীত বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরে মাগুরা, নড়াইল ও খুলনাতেও সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এরপরেও তিনি আবার কোলকাতায় ছুটে যান সংগীতে উচ্চ শিক্ষার তালিমের তাগিদে।
১৯৩৮ সালে প্রথম কলকাতা বেতারে সংগীত পরিবেশনের সুযোগ আসে। সেবার তিনি ছদ্মনাম আর.মুনশী (রবিন মুনশী) পরিচয়ে বেতারে গান পরিবেশন করেন। দীর্ঘ দিন তালিমের পরে ১৯৪২ সালে তিনি সংগীত কলাভবন থেকে সম্মানসূচক সার্টিফিকেট লাভ করেন। এরপরেই লক্ষ্ণৌর সংগীত বিশারদ শরজিৎ কাঞ্জিলালের কাছেও কিছুকাল তালিম নিয়েছেন। ভারত ও বাংলাদেশ মিলে সংগীত জগতে তাঁর অগণিত ভক্ত ও শিক্ষার্থী আজও ছড়িয়ে রয়েছেন।
সংগীতের এই গুরু বিখ্যাত কবি গোলাম মোস্তাফাকেও গান শিখিয়েছেন। কিন্তু গোলাম মোস্তাফা ছিলেন মুনশি রইস উদ্দিনের স্কুল শিক্ষক। এই উপমহাদেশের বহু খ্যাতনামা ও দেশ বরেণ্য সংগীত শিল্পী ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দীনের কাছে সংগীত শিখেছেন।
কর্মজীবন থেকেই তাঁর ব্রত হয়ে দাঁড়ায় শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষার প্রচার ও প্রসার। সংগীতে উৎসাহ সৃষ্টি করা, শিক্ষার্থী বৃদ্ধিকরণ এবং নতুন নতুন রাগসুর সৃষ্টি করা ইত্যাদি। দেশ বিভাগের পূর্বে সংগীতশিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হলে তিনি সংগীতের বহু বিষয়ে পাঠ্যবই রচনা করেন। ১৯৪০ সালে তিনি ‘সরল সঙ্গীতসার’ ও ‘সঙ্গীত শিক্ষা পদ্ধতি’ এই দুইটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি ঢাকা বেতারে শিল্পী হিসেবে যোগদান করেন এবং নারায়ণগঞ্জে স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন। তাঁরই উদ্যোগে নারায়ণগঞ্জে ‘প্রবেশিকা সংগীত বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি তার অধ্যক্ষপদে বৃত হন। ১৯৫৫ সাল থেকে তিনি ঢাকার বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর সহ-অধ্যক্ষ এবং ১৯৬৪ সালে অধ্যক্ষের পদ অলঙ্কৃত করেন। সেখানে আমৃত্যু তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
সংগীত শিক্ষক হিসেবে তিনি বহুল জনপ্রিয় হয়েছিলেন তাঁর শেখানোর কৌশল ও সংগীত শিক্ষা পদ্ধতির জন্য। রাষ্ট্রীয়ভাবেও তাঁর খ্যাতির কমতি ছিল না। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন পদক প্রাপ্ত এই সংগীতমুনির যে সকল গ্রন্থ রাষ্ট্রিকভাবে মর্যাদায় ভূষিত হয়েছে তার কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো :
১. ছোটদের সা-রে-গা-মা
২. অভিনব শত রাগ
৩. সংগীত পরিচয় (৭ম শ্রেণির পাঠ্য পুস্তক)
৪. গীত লহরী (৯ম ও ১০ম শ্রেণির পাঠ্য পুস্তক)
৫. প্রবেশিকা সংগীত শিক্ষা পদ্ধতি (৯ম, ১০ম শ্রেণির পাঠ্য পুস্তক)
৬. রাগ লহরী।
সংগীত গবেষক হিসেবে তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘অভিনব শতরাগ’ ১৯৬৬ সালে ‘দাউদ সাহিত্য পুরস্কার’ ‘আদমজী পুরস্কার’, সংগীত গবেষণার জন্যে এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিরল অবদানের স্বীকৃতিতে ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক ‘প্রাইড অফ পারফরমেন্স’ সম্মানে তাঁকে ভূষিত করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ রচিত হওয়ার কিছুকাল পরেই তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে। কিন্তু দেরিতে হলেও সংগীত শিক্ষা প্রসার ও উন্নতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য তাঁকে (১৯৮৫-১৯৮৬ সালে) বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয়ভাবে‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর) সম্মানে ভূষিত করা হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে অনিয়ম আর শহর ছেড়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে বেড়ানোর অবর্ণনীয় কষ্টক্লিষ্টতা হেতু ১৯৭২ সালে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সবকিছুর মায়া ভুলে এই কর্মময় পৃথিবী ছেড়ে ১৯৭৩ সালের ১১ এপ্রিল (১৩৮০ বঙ্গাব্দ, ২৮ চৈত্র) পরপারে চলে যান। সংগীতজ্ঞ, সংগীতগ্রন্থ প্রণেতা ও উচ্চাঙ্গ কণ্ঠশিল্পী, ওস্তাদ মুনশী রইস উদ্দিনকে ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে একটি কদম গাছের ছায়ায় তাঁকে সমাহিত করা হয়।
তথ্যসূত্র- ওস্তাদ মুনশী রইস উদ্দিনের কনিষ্ঠ সন্তান আশিকুজ্জামান টুলু (খ্যাতনামা সংগীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পী)।
বার্তা বাজার/এসজে