সর্বাঙ্গ পোড়ামাটির কাব্য গাঁথা শিল্পকর্মের নিদর্শন নবরত্ন মন্দির

ভারতীয় উপ-মহাদেশেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শত শত স্থাপত্য শিল্পকর্ম যা আজও পর্যটন ও প্রত্নতত্ত্ব প্রেমীদের কাছে টানে। এসব শিল্পকর্মেও মধ্যে রয়েছে রাজ-রাজাদের বিশাল আকৃতির প্রাসাদ, মসজিদ কিংবা মন্দির। তেমনই মধ্যযুগীয় স্থাপত্য শিল্পকর্মের অনন্য নিদর্শন সিরাজগঞ্জ জেলার সলঙ্গা থানার অর্ন্তগত হাটিকুমরুল ‘নবরত্ন মন্দির’। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এ মন্দিরটি ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে যুগ যুগ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

নবরত্ন মন্দিরটি স্থাপনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নজির পরিলক্ষিত হয়। একজন মুসলিম শাসকের অর্থায়নে তারই হিন্দু তহশিলদার দ্বারা এটি নির্মাণ করা হয়। স্থানীয়ভাবে এটি ‘দেলম ’ নামেও পরিচিত।

মন্দিরটির সর্বাঙ্গ পোড়ামাটির কাব্য গাঁথা। নবরত্ন মন্দিরকে ঘিরে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি শিব মন্দিরসহ আরও তিনটি ছোট মন্দির। প্রতিটি মন্দিরের দেয়ালই পোড়ামাটি কারুকার্য খচিত। বাংলাদেশে প্রাচীন মন্দিরগুলোর অন্যতম এটি।

শুক্রবার (১৯ মার্চ ২০২১) বিকেলে সরেজমিনে গেলে মন্দিরটি নির্মাণকালীন পাঠজাত সূত্রে জানা যায় ১৭০৪-১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে নবাব মুর্শিদ কুলি খানের শাসনামলে তার তহশিলদার রামনাথ ভাদুরী স্থাপন করেন ওই নবরত্ন মন্দিরটি। উঁচু একটি বেদীর উপর তিনতলা বিশিষ্ট এ মন্দিরটি ইট, চুন সুরকি মসল্লা দিয়ে নির্মিত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এ মন্দিরটি। প্রায় ১৫ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ১৫.৪ মিটার এবং প্রস্থ ১৩.২৫ মিটার।

নিচতলায় চারদিকে চারটি বারান্দা বিশিষ্ট একটি গর্ভগৃহ রয়েছে। এ যেন শিল্পকর্মের অনন্য নিদর্শন হাটিকুমরুল ‘নবরত্ন মন্দির’। প্রতিটি বারান্দার বাইরের দিক থেকে সাতটি ও ভেতরের দিকে রয়েছে পাঁচটি খিলাল প্রবেশ পথ। ছাদপ্রান্তে আংশিক বাঁকানো রয়েছে। মূল অবস্থায় মন্দিরের দেয়ালের ইট ও টেরাকোটার উপরে দেব-দেবী, লতাপাতা ও ফুলের চিত্রখচিত পোড়ামাটির অপূর্ব কারুকাজ।

যা ইতিহাসবিদ ও দর্শণার্থীদের আকৃষ্ট করেছে। তবে বার বার সংস্কারের কারণে অধিকাংশ কারুকার্য ধ্বংস হয়ে গেছে। নির্মাণকালীন সময়ে স্থাপনাটির উপরে পোড়ামাটির ফলক সমৃদ্ধ নয়টি রত্ন বা চূড়া নির্মাণ করা হয়েছিল। যার সবগুলোই এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। এ মন্দিরটি ঘিরে আরও তিনটি মন্দির রয়েছে। নবরত্ন মন্দিরের উত্তর-পূর্ব দিকে শিব-পার্বতী মন্দির, দক্ষিণপাশে পুকুরের পাড় ঘেঁষে রয়েছে টেরাকোটায় কারুকার্য খচিত আরও একটি শিব মন্দির। পশ্চিমে রয়েছে জোড় বাংলা মন্দির। এসব মন্দিরগুলোও একই ধরনের পোড়ামাটির কারুকাজে সুসজ্জিত ছিল।

মন্দির দেখতে আসা কলেজ পড়ুয়া মোছা. রুনা খাতুন তাঁর অনূভুতি ব্যক্ত করে বলেন, মাঝে মধ্যেই বান্ধুবীদের সাথে এই মন্দিরে আসি। এ যুগে অনেক আধুনিক বড় বড় ভবনই তো রয়েছে, তবে এরকম আর হয় না। স্থানীয় সুজন সেখ বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকেই নবরত্ন মন্দিরটি দেখে আসছি। এর গায়ে অনেক ছোট ছোট মূর্তি ছিল, সেগুলো খসে পড়ে গেছে। শিব মন্দিরটির উপরে একটি পোড়া মাটির কলসির মতো চূড়া ছিল। সেটাও ভেঙে পড়ে গেছে।

মন্দিরের পূর্ব পাশের মুদি ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন বলেন এক সময় এ মন্দিরটি ছিল অবহেলিত। এখানকার হিন্দুরাও পূজা-অর্চনা করতো না। প্রায় ১০ বছর ধরে এখানে দুর্গা পূজা করা হচ্ছে। হিন্দু-মুসলিম সবাই এখন আনন্দঘন পরিবেশে শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করে। নবরত্ন মন্দিরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দায়িত্বরত্ব পাহারাদার মো. মহাব্বত আলী সেখ বলেন, মন্দিরে প্রতিদিন প্রায় চার শতাধিক লোকজন প্রবেশ করে। তবে সাপ্তাহিক শুক্র ও শনিবার এবং বিশেষ দিন গুলোতে তার দ্বিগুন হয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা এখানে বেড়াতে আসে।

শাহজাদপুর রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির কাস্টোডিয়ান তানভির মাহমুদ মুঠোফোনে বলেন, অপূর্ব কারুকার্য খচিত নবরত্ন মন্দিরটি সব ধরনের পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এটিই সব থেকে প্রাচীন ও চমৎকার একটি মন্দির। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আ লিক পরিচালক (রাজশাহী ও রংপুর) নাহিদ সুলতানা জানান, ইতোমধ্যে ওই স্থাপনাটির সৌন্দর্য্যবর্ধন ও বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। আরও বড় একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সেটি অনুমোদন হলে মন্দিরটি পর্যটকদের জন্য আরও আকর্ষণীয় হবে।

এম এ মালেক/বার্তা বাজার/শাহরিয়া

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর