ছন দিয়েই ভাগ্য বদলাতে চান শেরপুরের নারীরা

বগুড়ার শেরপুর পৌর শহর হতে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে এগোলেই চোখে পড়ে সবুজে ঘেরা গ্রাম। শহর সংলগ্ন হলেও শহরের হাওয়া খুব একটা লাগেনি। গ্রামের ভিতর ঢুকলেই চোখে পড়বে নারীদের জটলা। কোথাও সারিবদ্ধভাবে বসেছেন তারা। কোথাও বা বসেছেন এলোমেলোভাবে। অনেক জায়গায় আবার গোল করে বসে একমনে কাজ করে যাচ্ছে মেয়েরা। প্রত্যেকের হাতেই রয়েছে, ছন আর সুঁই। আর তা দিয়েই তৈরি করছেন রকমারি পণ্য। স্থানীয়ভাবে যা ছনের ডালা নামেই পরিচিত। তবে ছনের তৈরি এসব পণ্যকে ডালা অথবা ঝুঁড়ি বা বাস্কেট বলা হয়ে থাকে। আর হস্তশিল্পের এই কাজটি করে থাকেন নারীরা। এ কাজেও রয়েছে মজুরী বৈশম্য। বাধ্য হয়ে এ বৈশম্যকে মেনে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তারা।

গাড়ীদহ ইউনিয়নের হাপুনিয়া, মহিপুর, বনমরিচা, গোসাইবাড়ী, কুসুম্বী ইউনিয়নরে বাগড়া, বাগড়া কলোনি টুনিপাড়া, খানপুর ইউনিয়নের কয়েরখালি, গোপালপুর, শালফা, চৌবাড়িয়া, বিশালপুর ইউনিয়নের তাজপুর, পেচুঁল, ভাটগাড়ী, ভবানীপুর ইউনিয়নের আমিনপুর, ছোনকা, বেলগাড়ি, সীমাবাড়ী ইউনিয়নের বেটখের, ররোয়া, চান্দাইকোনা, সুঘাট ইউনিয়নের চোমরপাথালিয়া, জয়লাজুয়ান সহ প্রায় ৪০ গ্রামের নারী-পুরুষ এখন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

খোজ নিয়ে জানা যায়, বগুড়ার শেরপুরের হাপুনিয়া গ্রামে প্রায় ৪০ বছর আগে সীমিত আকারে কয়েকজন পুরুষের সহযোগিতায় ডালা তৈরির কাজটি শুরু করেন নারীরা। বর্তমানে এই গ্রামসহ আশ-পাশের প্রায় ৪০টি গ্রামের অন্তত ৮ থেকে ১০ হাজার নারী সাংসারিক কাজের ফাঁকে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন এই কাজের সঙ্গে। আর নারীদের হাতের তৈরি রকমারি এসব পণ্য দেশের সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে ইউরোপের দেশগুলোতে। এ থেকে আসছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। পাশাপাশি স্বাবলম্বী হয়েছেন এসব গ্রামের অসংখ্য অবহেলিত নারী।

ডালার গ্রাম খ্যাত বগুড়ার শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ ইউনিয়নের হাপুনিয়াসহ কয়েকটি গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় ৪০ বছর আগে নওগাঁ জেলার মোজাফফর হোসেন নামের একব্যাক্তি এই গ্রামে এসে প্রথম ডালা তৈরির কাজ শুরু করেন। ওই ব্যক্তি তখন গ্রাম ঘুরে ঘুরে নারীদের দলবদ্ধ করেন। এমনকি ওই সময় আইসিডব্লিউ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে নারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেন তিনি। পরে হাপুনিয়া ও পাশের মহিপুর গ্রামের আরো প্রায় ৪০ জন নারী-পুরুষকে নিয়ে ঢাকায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন মোজাফফর হোসেন। তবে ওই সময় প্রশিক্ষণ নেয়া ব্যক্তিদের কেউ বেঁচে রয়েছেন কি-না তা জানা নেই তাদের।

হাপুনিয়া গ্রামের আরেক গৃহবধূ বুলবুলি খাতুন বলেন, সময় তো আর কারো জন্য বসে থাকে না। তেমনি কাজও কারো জন্য অপেক্ষা করে না। তাদের দেখানো পথ ধরেই এগিয়ে চলছে ডালা তৈরির কাজ। কালের আবর্তে আশেপাশের ৪০ গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে ডালা বানানোর এই কাজটি। জয়নব বেগম নামের এক নারী বলেন, ডালাখ্যাত গ্রামের নারীরা সাংসারিক কাজের ফাঁকে নিজ বাড়িতে বসে তৈরি করছেন রকমারি ডালা। বিনিময়ে পাচ্ছেন পারিশ্রমিক। আর তাতে বাড়তি আয় যোগ হচ্ছে সংসারে। এছাড়া প্রায় বাড়িতেই মায়েদের পাশাপাশি স্কুল পড়ুয়া মেয়েরাও ডালা তৈরির কাজ করে থাকেন বলেও জানান তিনি। তবে মজুরী কম হওয়ায় পোশাচ্ছেনা তাদের।

আরো জানা যায়, মূলত ১৯৯০ সাল থেকে ডালা হস্তশিল্পের প্রসার ঘটতে থাকে। আস্ক হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট, ঢাকা হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট, সান ট্রেড হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট, কনেস্পো হ্যান্ডিক্র্যাফ্টসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা এ শিল্পের উপর কাজ করছে। এসব সংস্থার প্রধানরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যান এবং নানা ডিজাইনের ডালা অর্থাৎ ঝুড়ি তৈরির অর্ডার নিয়ে আসেন। সে অনুযায়ী এসব সংস্থার স্থানীয় প্রতিনিধিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নির্ধারিত ডিজাইন ও ছন দিয়ে থাকেন। পরে, ঝুড়ি তৈরি শেষে ছনের দাম বাদে অবশিষ্ট টাকা দিয়ে তা কিনে নেন।

রাশেদুল হক/বার্তাবাজার/ভি.এস

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর