মেগা প্রকল্পের কাজ পাচ্ছে বিতর্কিত কনসোর্টিয়াম

মাতারবাড়িতে এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ দেওয়া নিয়ে শুরুতেই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

কক্সবাজারের মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রে দুই হাজার ছয়শ কোটি টাকা ব্যয়ে এই মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। এত বড় কাজটি একশ ডলার মূলধনের দেশীয় প্রতিষ্ঠান এবং ঘুষ দেওয়ায় বিভিন্ন দেশে দণ্ডপ্রাপ্ত দুই কোম্পানিসহ তিন প্রতিষ্ঠান নিয়ে গড়া কনসোর্টিয়ামকে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এদের কাজ দেওয়া হলে প্রকল্পটি ভেস্তে যাওয়ার শঙ্কা আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, কনসোর্টিয়ামের সদস্য কোম্পানিগুলো হলো জাপানি মারুবেনী করপোরেশন, সুইস ট্রেডিং ফার্ম ভিটল এবং স্থানীয় এজেন্ট পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল। এর মধ্যে বাংলাদেশি কোম্পানি পাওয়ারকোর পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১০০ ডলার।

এই কনসোর্টিয়ামের অপর সদস্য ভিটলের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুষ দেওয়ার ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে গত ডিসেম্বরে ঘুস দেওয়ার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ভিটলকে ১৬৪ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করেছে।

এছাড়া ইথিওপিয়া ও মেক্সিকোতেও এই কোম্পানির বিরুদ্ধে ঘুস প্রদানের অভিযোগে জরিমানা দেওয়ার অভিযোগ আছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্র্র সরকারের এক তদন্তে এর সতত্য মিলেছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশে কাজ করতে গিয়ে মারুবেনি দুর্নীতি করায় একবার জাইকা কর্তৃক কালো তালিকাভুক্তও হয়েছিল। এছাড়া এদের এ ধরনের কাজ করার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতারও ঘাটতি আছে।

এ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এত কিছুর পরও রহস্যজনক কারণে এই কনসোর্টিয়ামকে বেছে নিয়েছে বিপিসি। অথচ এই মেগা প্রকল্পের কাজ পাওয়ার জন্য আরও ৩টি বিদেশি কোম্পানি তাদের আগ্রহপত্র জমা দিয়েছে বিপিসির কাছে। ইতোমধ্যে বিপিসি অভিযুক্ত কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে এমওইউ (মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং) করার জন্য জ্বালানি বিভাগকে চিঠি দিয়েছে।

গত ১৯ জানুয়ারি বিপিসি চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দীক এই চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি এই কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষরের অনুমতি প্রদানের জন্য বলেন। গণমাধ্যমের অনুসন্ধান, বিপিসির চিঠি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ব্ল–মবার্গের তথ্য বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। সূত্র জানায়, জাপান তার দেশীয় সংস্থা জাইকার মাধ্যমে এ প্রকল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করে।

জাপানি কোনো প্রতিষ্ঠানকে লিড পার্টনার করে একটি কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছিল তারা। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছর জাপানের মিৎসুই দক্ষিণ কোরিয়ার এলপিজি কোম্পানি এসকে গ্যাসকে সঙ্গে নিয়ে একটি যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব বিপিসির কাছে জমা দেয়।

দীর্ঘদিন পরে আরও দুটি কোম্পানি এই প্রকল্পে কাজ করার জন্য তাদের আগ্রহপত্র জমা দেয়।

জানা গেছে, বিপিসি প্রস্তাবগুলোর সারসংক্ষেপ তুলে ধরে সিদ্ধান্তের জন্য জ্বালানি বিভাগের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে একটি কনসালটেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করার জন্য নির্দেশ দেয়। জ্বালানি বিভাগ সে অনুযায়ী বিপিসিকে কনসালটেন্ট নিয়োগের চিঠি দেয়।

জ্বালানি বিভাগের ওই নির্দেশনায় বলা হয় জ্বালানি খাতের কোনো সংস্থাকে দিয়ে এই কনসালটেন্ট নিয়োগ করার জন্য। কিন্তু অভিযোগ উঠে বিপিসি এই কনসালটেন্ট নিয়োগের জন্য পেট্রোবাংলাকে দায়িত্ব না দিয়ে রহস্যজনক কারণে বিদ্যুৎ বিভাগের অধীন সংস্থা পাওয়ার সেলকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য জ্বালানি বিভাগের কাছে চিঠি দেয়। যদিও পাওয়ারসেল সাধারণত জ্বালানি বিভাগ নিয়ে তেমন কোনো কাজ করে না।

এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে বিপিসি। শেষ পর্যন্ত জ্বালানি বিভাগ বিপিসির এই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। জ্বালানি বিভাগ থেকে বিপিসিকেই কনসালটেন্ট হিসাবে প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, বিপিসি এরপর প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করে মারুবেনীকে টার্মিনাল করার দায়িত্ব দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। এ প্রসঙ্গে খোদ বিপিসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, মারুবেনীর গভীর সমুদ্র বন্দরে এ জাতীয় এলপিজি টার্মিনাল করার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এছাড়া বাংলাদেশে কাজ করতে গিয়ে মারুবেনী দুর্নীতি করায় একবার জাইকা কর্তৃক কালো তালিকাভুক্তও হয়েছিল। মারুবেনীর বাংলাদেশি আরেক পার্টনার পাওয়ার কো সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত একটি কোম্পানি। সেখানে তাদের পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১০০ ডলার।

বাংলাদেশ কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা সবসময় বিতর্কিত সংস্থাগুলোকে উন্নয়ন প্রকল্প প্রদান করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এই প্রকল্পটি তার অন্যতম উদাহরণ। তিনি কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসা করেন, আমরা কি আদর্শিক মান বজায় রাখার জন্য একটি জাতি হতে পারি না? এই প্রকল্পে অংশ নেওয়া কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে কর্তৃপক্ষের উচিত আদর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া।’

বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আবু বকর ছিদ্দিক গণমাধ্যমকে বলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা হচ্ছে জ্বালানি বিভাগের। এ কারণে তাদের তৈরিকৃত প্রস্তাব লিখিতভাবে জ্বালানি বিভাগের কাছে পাঠানো হয়েছে। এখন তারা যে সিদ্ধান্ত নেবে তা বিপিসি বাস্তবায়ন করবে।

পাওয়ারকো একটি দেশীয় কোম্পানি। কোম্পানিটি সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত এবং পরিশোধিত মূলধন ১০০ ডলার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। কনসোর্টিয়ামের অপর সদস্য ভিটলের বিরুদ্ধে ঘুস প্রদানের অভিযেগে জরিমানা করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে এই প্রসঙ্গে তিনি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

গণমাধ্যমের অনুসন্ধান দেখা গেছে বিপিসি যে কনসোর্টিয়ামকে কাজ দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত করেছে তাদের অন্যতম পার্টনার কোম্পানি পাওয়ার কো’র স্থানীয় একটি অফিস রয়েছে বনানীতে। কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে যে পাঁচজন কর্মচারীর তালিকা দেওয়া হয়েছে তাতে তারেক খলিলুল্লাহ এবং নাবিল খান নামে দুজনের নাম রয়েছে।

এছাড়া সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত কোম্পানির প্রোফাইল থেকে দেখা গেছে সিঙ্গাপুরে পাওয়াকো দুজনের নামে নিবন্ধিত হয়েছে। এতেও নাবিল খানের নাম রয়েছে। এছাড়া মোহাম্মদ মুরাদ হাসান নামে আরেকজনের নামও রয়েছে। পাওয়ার কোর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী ভিটলের সঙ্গে তাদের পার্টনারশিপ রয়েছে। মূলত ভিটলের স্থানীয় এজেন্ট হিসাবে কাজ করছে পাওয়ার কো।

মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিপিসির চিঠিতে বলা হয়েছে, মাতারবাড়িতে অবস্থিত গভীর সমুদ্র বন্দরে বিপিসির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এলপিজি টার্মিনাল স্থাপনের জন্য ৬টি প্রতিষ্ঠান আনসলিসিটেড (অযাচিত) প্রস্তাব প্রদান করেছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি ও ৩ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ে দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর ধারবাহিকতায় জাপানের অন্যতম কোম্পানি মারুবেনী করপোরেশন ও সিঙ্গাপুরের মেসার্স ভিটল এশিয়া লিমিটেড ও বাংলাদেশের পাওয়ার কো ইন্টারন্যাশনাল একটি প্রস্তাব দেয়। এছাড়া যৌথভাবে জাপানের জেইসিস করপোরেশন ও নেদারল্যান্ডসের এসএইচভি এনার্জিও আলাদা প্রস্তাব দেয়। তাদের প্রস্তাবগুলো বিপিসি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করে।

বিপিসি তাদের যাচাই-বাছাইকালে প্রতিষ্ঠানগুলোর এলপিজি টার্মিনাল প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার অভিজ্ঞতা, এলপিজি বাণিজ্যে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বিপিসির সঙ্গে মালিকানা শেয়ারিং, প্রস্তাবিত টার্মিনাল স্থাপনের বিশদ পরিকল্পনা ও কাজ সম্পন্ন করার সম্ভাব্য মেয়াদ ও ব্যয়, ঋণ-বিনিয়োগ অনুপাত ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি অগ্রাধিকার দেয়। তুলনামলক বিবরণীতে দেখা যায় জাপানের মারুবিনী করপোরেশন যে প্রস্তাব দিয়েছে তা অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে তাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। যার কারণ পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের লক্ষ্যে তারা একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চান। সূত্র: যুগান্তর।

বার্তাবাজার/ই.এইচ.এম

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর