বাংলাদেশের সংবাদপত্রে কার্টুন ছাপানো কমে যাচ্ছে যে কারণে

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোকে বিশেষ করে শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় এক দশক আগেও নিয়মিতই কার্টুন প্রকাশ করতে দেখা যেতো, যেগুলো প্রায়শই ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিতো। কিন্তু এখন আর পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় কার্টুন বিশেষ করে রাজনৈতিক কার্টুন খুব একটা চোখেই পড়ে না।

দেশটির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের অনেকে গত কয়েকদিন ধরে পুরনো কিছু কার্টুন ব্যাপকভাবে শেয়ার করছেন, যেগুলো শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো ২০০১ সাল থেকে শুরু করে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তখনকার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে।

তখন দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর কয়েকটির কার্টুনিস্টরাও ব্যাপক পরিচিত পেয়েছিলেন এ ধরণের কার্টুনগুলোর মাধ্যমে। সংবাদপত্রের একজন নিয়মিত পাঠক রওশন আরা মুক্তা বলছেন এখন আর তেমন কার্টুন তার চোখে পড়ে না।

“এক সময় অনেক দেখতাম কার্টুনগুলো। বেশ জ্বালাময়ী কার্টুন যাতে অনেক বার্তা থাকতো। কিন্তু এখন আর তেমনটা চোখে পড়েনা,” তিনি বলেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু করে পরে স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসনের সময়েও দেশটির সংবাদপত্রে কার্টুন ছাপা হতো নিয়মিত।

নব্বই সালে জেনারেল এরশাদের বিদায়ের পর নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পরের দু দশকে সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় আলোচিত নানা ইস্যু বা ব্যক্তিকে ঘিরে আঁকা কার্টুন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

কিন্তু এখন কার্টুনকে ঘিরে সংবাদপত্রগুলোর সেই আগ্রহ আর নেই বলেই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার শিক্ষক শামীম রেজা।

“৯০ থেকে পরের দু দশকে দেখা গেছে কার্টুন হয়েছে সমসাময়িক বিষয়ে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তখন প্রথম পাতাতেই কার্টুনের রীতি তৈরি করেছিল কেউ কেউ। অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক কিংবা সংস্কৃতি জগতের মানুষকে নিয়ে কার্টুন হয়েছে।

”এটাকে ঘিরে এ ধরনের অনেক শিল্পীও জনপ্রিয় হয়েছিলেন। এটা নাই হতে হতে এখন একেবারেই নেই। বিশেষ করে রাজনৈতিক কার্টুন এখন শূন্যের কোঠায়,” তিনি বলেন।

মিস্টার রেজা বলছেন যে কোনো কারণেই হোক কার্টুনকে ঘিরে সম্পাদকীয় নীতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে বা আনতে তারা বাধ্য হয়েছে কার্টুনকে ঘিরে।

কার্টুনিস্ট হিসেবে সুপরিচিত ইংরেজি দৈনিক দা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার খান দু’দশকের বেশি সময় কাজ করেছেন আরেকটি ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে। তার অসংখ্য কার্টুন ডেইলি স্টারের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল।

মি. খান বলছেন কার্টুন নিয়ে আগের মতো সহনশীলতার পরিবেশ এখন আর নেই বলেই মনে করেন তিনি।

“আসলে কার্টুন হলো স্যাটায়ার ও একধরনের মতের প্রকাশ। একটা স্যাটায়ারের মাধ্যমে মত প্রকাশ করা যায়। যেহেতু সহনশীলতার মাত্রা কমে গেছে বা কার্টুনিস্ট বা মিডিয়াগুলোর ওপর যা প্রতিক্রিয়া এসেছে সে কারণেই সেলফ সেন্সরশিপ তৈরি হয়েছে কার্টুন নিয়ে। সেজন্যই কার্টুনগুলো দেখা যায় না।”

কার্টুন আঁকতে আগের মতো স্বস্তি পান কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি জানি না যে আমি যদি দেশের পলিসি নিয়ে কার্টুন আঁকি সেটার জন্য কোন কালো আইনের প্রয়োগ আমার ওপর হবে না।”

বাংলাদেশে সম্প্রতি কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর মুক্তি পাওয়ার পর কার্টুনের জন্য তাকে নির্যাতনের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, কার্টুনকে কেন্দ্র করে এটিই একমাত্র ঘটনা নয়।

এর আগে একটি জাতীয় দৈনিকের ফান ম্যাগাজিনে একটি কার্টুনের জন্য সম্পাদকের ক্ষমা চাওয়ার ও কার্টুনিস্টকে জেলে পাঠানোর ঘটনাও ঘটেছিলো।

ওদিকে কার্টুন নিয়ে এমন উদ্বেগ শুধু সুপ্রতিষ্ঠিত কার্টুনিস্টদের মধ্যেই নেই। বরং তরুণ কার্টুনিস্টদের একজন চন্দ্রিকা নূরানি ইরাবতি বলছেন তারাও এখন অনুধাবন করতে পারছেন যে কার্টুন বিশেষ করে প্রভাবশালীদের নিয়ে কার্টুন আকা ঝুঁকির কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“আমার মনে হয় এটা আঁকা ঠিক হবে, না কি হবে না? কোন পর্যন্ত আঁকা ঠিক হবে? রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কোন কার্টুনই আঁকা যাবে না,” তিনি মন্তব্য করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শামীম রেজা অবশ্য বলছেন বাস্তবতার কারণেই কার্টুন প্রকাশের বিষয়ে সংবাদপত্রগুলো দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়েছে, যার ফলে সংবাদপত্রগুলো কার্টুন আঁকলেও সেখানে এখন ব্যক্তি চরিত্রের বদলে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ইস্যু গুরুত্ব পাচ্ছে।

তবে এসব বিষয়ে যোগাযোগ করলে অন্তত তিনটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। সূত্র: বিবিসি।

বার্তাবাজার/ই.এইচ.এম

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর