দেশে চাল আমদানিকারকদের গড়িমসি, ঘাটতি থাকতে পারে এপ্রিল পর্যন্ত

বাংলাদেশে চাল আমদানিকারকদের গড়িমসি এবং সরকারের কিছু নিয়মের জটিলতায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাল আমদানির টার্গেট পূরণ করা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বেসরকারি চাল আমদানিকারকরা হাজার হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি নেয়ার পরও প্রক্রিয়া শুরু করতে বিলম্ব করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, বোরা ধান না আসা পর্যন্ত অর্থাৎ এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ টন চাল আমদানি করা গেলে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, চাল আমদানির টার্গেট পূরণ না হলে এপ্রিল মাস পর্যন্ত চালের ঘাটতি থাকতে পারে।

তবে আমদানিকারকরা অভিযোগ করেছেন, এখন সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি আমদানিকারকদেরও ভারতের চালের বাজারের ওপর নির্ভর করার কারণে সেখানে দাম বেড়ে গেছে।

এছাড়া বিশ দিনের মধ্যে চাল আমদানি করে তা বাজারজাত করার বাংলাদেশ সরকারের সময়সীমা নিয়েও তারা আপত্তি তুলেছেন।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলছেন, কিছু জটিলতা ছিল এবং সেগুলোর নিরসন করা হয়েছে। এখন হিলি স্থলবন্দর সহ বিভিন্ন বন্দর দিয়ে আপেক্ষায় থাকা চাল দেশে প্রবেশ করবে।

তিনি দাবি করেন, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

সরকার বেসরকারি আমদানিকারকদের মাধ্যমে পাঁচ লাখ টন চাল আমদানির টার্গেট নিয়েছে।

আমদানিকারকরাও হাজার হাজার টন চাল আমদানির সরকারি অনুমতি নিয়েছেন।

কিন্তু অনুমতি নিলেও বেশিরভাগ আমদানিকারকই ঋণপত্র বা এলসি খোলাসহ প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াগুলো এখনও শুরু করেননি বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

শীর্ষ পর্যায়ের একজন আমদানিকারক আবুল বশর চৌধুরী ১০,০০০ টন চাল আমদানির অনুমতি পেয়েছেন। তিনি তিনিও এখনও আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেননি।

মি. চৌধুরী আমদানির সময়সীমা এবং সরকারের কিছু নিয়মের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন।

“বলা হয়েছে, সাত দিনে মধ্যে এলসি খুলতে হবে। আর চাল আনার পর ২০দিনের মধ্যে বাজারজাত করতে হবে। এই অল্প সময়ের মধ্যে নিয়ে আসাটা আসলে কঠিন,” তিনি মন্তব্য করেন।

আবুল বশর চৌধুরী আরও বলেন, “শুধু সিদ্ধ চাল এবং ব্রোকন চালের জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে। এই চাল বেশি দামে এনে লাভ হবে না। চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সাধারণ মানুষ আতপ চাল খেয়ে থাকে। সেই চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। এসব বিভিন্ন সমস্যার কারণে সরকার যে পরিমাণ চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে, সে পরিমাণে কিন্তু আমদানি হচ্ছে না।”

বেসরকারিভাবে আমদানির টার্গেট পূরণ করা সম্ভব হবে কিনা-তা নিয়ে আমদানিকারকরাই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

তবে আমদানিকারকদের পাশাপাশি সরকার টেণ্ডারের মাধ্যমে আড়াই লাখ টন চাল আনার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেই প্রক্রিয়াও এখনও চলছে।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, চারশ’র বেশি আমদানিকারকে অনুমতি দেয়া হয়েছে। টেণ্ডারের মাধ্যমে যারা চাল দিচ্ছে তাদের পাশাপাশি অনেক আমদানিকারকের চাল হিলি স্থল বন্দরের কাছে সীমান্তে এসে আছে।

শুল্ক নিয়ে সমস্যা হয়েছিল এবং তার সমাধানের পর এখন চাল বাংলাদেশের ঢুকতে শুরু করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

“অনেকে চাল নিয়ে এসে সীমান্তে বসে আছে। কিন্তু এসএস কোড এর সমস্যা হয়েছে। চাল আমদানির জন্য কাষ্টমস ক্লিয়ারেন্সের একটা কোড নাম্বার থাকে, সেটা এস এস কোড। যেটা ২৫ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে চালটা আমদানিকারকদের ছাড় করতে হবে। সেই কোড পরিবর্তন করে সমস্যার সমাধান করা হয়েছে।”

খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেন, এখন সব স্থল বন্দরে অপেক্ষমান চাল বাংলাদেশে ঢুকবে এবং বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এবার চালের ঘাটতির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মি. মজুমদার জানান, গত বছর বন্যার কারণে আমন ফলন কম হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারিতে দেশের মানুষের একটা বড় অংশকে সরকারের মজুত থেকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। এছাড়া আমন মৌসুমের পর চাল মিল মালিকরা সরকারের কাছে চাল বিক্রি করেনি। এসব কারণে চাল আমদানি করতে হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আমদানিকারকদের পাশাপাশি সরকার আন্তর্জাতিক টেণ্ডারের মাধ্যমে আড়াই লাখ টন চাল সংগ্রহ করছে।

এছাড়া সরকার ভারত সরকারের সাথে জি টু জি চুক্তির মাধ্যমেও চাল আনছে।

নওগাঁ থেকে একজন চাল ব্যবসায়ী নিরোদ বরন সাহা বলেন, “সরকার তার প্রয়েজনে চাল কিনছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক টেণ্ডারের মাধ্যমে যে চাল কেনা হচ্ছে, ভারতের চাল রপ্তানিকারকরাই মুলত এই টেণ্ডার পেয়েছে। এদের টেণ্ডার বেশি হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবে ভারতের চালের বাজার বেড়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “যেহেতু করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্য দেশে চালের দাম বেশি।সেখানে ভারতে তুলনামূলক দাম কম। কিন্তু সরকারও যখন ভারত থেকে চাল আনছে এবং বেসরকারি আমদানিকারকরাও ভারতেই যাচ্ছে। সেজন্য সেখানেও দাম বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি আমদানিকারকরা আগ্রহী হচ্ছে না।”

তবে ঢাকায় চালের পাইকারি ব্যবসায়ী বা আড়তদারদের একজন জানিয়েছেন, চালের ঘাটতির সুযোগ বুঝে আমদানিকারকরা গড়িমসি করছে।

গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস এর সিনিয়র গবেষক ড: নাজনীন আহমেদ বলেন, আমদানিকারকরা অল্প সময়ের জন্য চাল আমদানির ক্ষেত্রে লাভ লোকসানের হিসাব নিকাশ করছে।

“যাদের অনেক বড় অটো রাইস মিল, তাদের মিল চালু রাখতে হবে। মিল চালু রাখতে হলে যে পরিমাণ ধান তিনি স্বাভাবিক ব্যবসার জন্য কিনবেন, সেই ধান তার কাছে আছে। সেটা ভাঙাচ্ছেন এবং সেই চাল উনি বিক্রি করছেন। কাজেই তার আমদানি করার দরকার নাই।”

তিনি আরও বলেন, “বাকি আমদানিকারকরা চিন্তা করছে যে আমি আমদানি করতো বেশি দাম পাব না। অল্প কিছুদিন পরেইতো বোরো ধান উঠে যাবে।”

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, সরকার চাল আমদানির তৎপরতা শুরু করার পর চালের উর্ধ্বমুখী বাজার একটা স্থির অবস্থায় এসেছে।

তিনি মনে করেন, “দেশের অভ্যন্তরেও চাল যা আছে, সরকার সংগ্রহ মুল্য ৩৭ টাকা কেজির জায়গায় একটু বাড়িয়ে ৪০ টাকা করলে মিল মালিকদের কাছ থেকেও সরকার চাল সংগ্রহ করতে পারবে।”

যদিও আমদানিকারকদেরই অনেকে চাল আমদানির টার্গেট পূরণ হওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

কিন্তু খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, চাল আমদানি টার্গেট পূরণ হবে এবং চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ না হওয়া পর্যন্ত আমদানি অব্যাহত থাকবে।

তিনি মনে করেন, চালের ঘাটতি হবে না। -বিবিসি বাংলা

বার্তাবাজার/এ.আর

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর