২৫ হাজার ২৩০ কোটি টাকা আয়কর ফাঁকির খাতায়

অনাদায়ি পড়ে আছে প্রায় ২৫ হাজার ২৩০ কোটি টাকা আয়কর। প্রকৃত আয় গোপন দেখিয়ে ও লোকসানের অযুহাতে গত ৯ বছর ধরে এই কর ফাঁকি দিয়ে আসছে বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, মোবাইল অপারেটর, প্রথম সারির ব্যাংক, বীমা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা।

করদাতাদের রিটার্ন অডিট করে কর অফিস এই বিশাল ফাঁকি উদঘাটন করেছে। কিন্তু কর অফিসের দেওয়া আদেশ পেয়ে করদাতারা আপিল, ট্রাইব্যুনাল ও আদালতের শরণাপন্ন হওয়ায় আরও অনাদায়ি হয়ে পড়ছে এই অংক। যা বাড়ছে প্রতিবছরই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে সর্বশেষ অনাদায়ি করের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, একজনের রিটার্ন জমা দেওয়ার পর দুই পদ্ধতিতে সেতা যাচাই করা হয়। প্রথমবার যদি হিসাবে গরমিল পাওয়া যায় নোটিশের মাধ্যমে তা জানিয়ে জমা দেওয়ার কথা বলা হয়া হয়। আয়কর মেলায় দাখিল করা ব্যক্তিশ্রেণির রিটার্ন এ পদ্ধতিতে অডিট করা হয়।

দ্বিতীয়বার সাধারণ বড় বড় রিটার্ন এ পদ্ধতির অডিটের জন্য নির্বাচন করা হয়। কোনো রিটার্নের বিষয়ে কর কর্মকর্তাদের সন্দেহ হলে তা অডিটের জন্য অনুমোদন চাওয়া হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা ট্যাকসেস বার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সুফি মোহাম্মদ আল মামুন বলেন, কর অফিস যৌক্তিকভাবে রিটার্ন অ্যাসেসমেন্ট না করায় অনাদায়ি করের উদ্ভব হয়। এখন পর্যন্ত যত কর অনাদায়ি আছে, তা আদায় হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তিনি আরও বলেন, রিটার্ন অডিট বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। কর অফিসগুলো দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে রিটার্ন অডিটের জন্য বাছাই করে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে কর্মকর্তারা স্বেচ্ছাচারিতার ভিত্তিতেই রিটার্ন বাছাই করেন। আর অডিটে দাবি উত্থাপিত হলে তা নিষ্পত্তিতে করদাতাকে কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। তখন করদাতাদের বাধ্য হয়ে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়। আর কর অনাদায়ি হয়ে পড়ে।

সুফি মামুন আরও বলেন, এনবিআর অনাদায়ি কর আদায়ে ও মামলা নিষ্পত্তিতে এডিআর (অল্টারনেটিভ ডিসপুট রিসলিউশন বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) ব্যবস্থা চালু করলেও তা কার্যকর করতে পারেনি। এর কারণ এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর কর্মকর্তারা অবসরে যাওয়ার পর তাদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এক কথায় এডিআরের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। ওইসব কর্মকর্তা তার বিভাগের বাইরে করদাতার হয়ে কথা বলেন না।

অবশ্য আয়কর কর্মকর্তারা বলছেন ভিন্ন কথা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিশেষ কিছু নির্ণায়কের মাধ্যমে রিটার্ন অডিটের জন্য বাছাই করা হয়। এক্ষেত্রে করদাতার আগের বছরের প্রদেয় কর, আর্থ-সামাজিক অবস্থান, নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া গোপন সংবাদকে বিবেচনা করা হয়। পরে এনবিআরের অনুমোদন নিয়ে করদাতার নথি পুনঃউন্মোচিত করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রকৃত আয়ের তথ্য গোপন করতে দেখা গেছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, যথাযথভাবে হিসাব না করে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ায় দাবির সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তি করদাতাদের অনেকেই দাবি করা আয়কর দিয়ে দিচ্ছেন বা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আবার অনেকে আপিল-ট্রাইব্যুনাল বা আদালতে মামলা করছেন। এ কারণে ওই কর আদায়ে বিলম্ব হচ্ছে। এক্ষেত্রে এডিআর ব্যবস্থার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে করদাতাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।

এনবিআরের সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, কর কর্মকর্তারা ২০১০-১১ থেকে ২০১৮-১৯ করবর্ষের অক্টোবর পর্যন্ত জমা দেওয়া রিটার্ন অডিটের মাধ্যমে ২৭ হাজার ২৬২ কোটি টাকা কর ফাঁকি উদঘাটন করে। এর মধ্যে ২ হাজার ৯০১ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। বাকি ২৪ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা অনাদায়ি রয়েছে। সবচেয়ে বেশি রিটার্ন অডিট করা হয় ২০১৩-১৪ করবর্ষে ৩২ হাজার ৩৪৪টি। ওই বছর ৫ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা কর দাবি করা হয়। আর ২০১১-১২ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষে সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে (আয়কর মেলায় জমা পড়া রিটার্ন) জমা দেওয়া রিটার্ন যাচাই করে এক হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি উদঘাটন করা হয়। এর মধ্যে ১৩১ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। বাকি ৮৭০ কোটি টাকা অনাদায়ি।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কর কর্মকর্তারা জোরপূর্বক নিজের মনমতো অ্যাসেসমেন্ট করে থাকে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে হয়রানিমূলক অ্যাসেসমেন্টও করা হয়। এসব কারণে কর অনাদায়ি হয়ে পড়ে। তিনি আরও বলেন, চাপিয়ে দেওয়া কর থেকে রেহাই পেতে করদাতারা ট্রাইব্যুনালে যেতে চান না। কারণ ট্রাইব্যুনালেও আয়কর ক্যাডারের কর্মকর্তারা বিচার করে থাকেন। আর বিচারিক কর্মকর্তা অনেক সময় তারও ব্যাচমেট বা সিনিয়র কর্মকর্তার রায়ের বিরুদ্ধে রায় দিতে সংকোচবোধ করেন। তার বাধ্য হয়েই করদাতারা আদালতের শরণাপন্ন হন। অনাদায়ি কর আদায় করতে হলে এডিআর কার্যক্রম জোরদার এবং করদাতাদের এডিআরে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

এনবিআরের আয়কর বিভাগের সাবেক সদস্য আমিনুর রহমান বলেন, অনাদায়ি করের যে হিসাব এনবিআর দেয় তার নির্ভরযোগ্যতার অভাব আছে। অনেক কর আদায় হলেও তা হিসাবের মধ্যে আসে না। শুরুতে যে ছকে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তার ওপর শুধু নতুন তথ্য যোগ করা হয়।

কিন্তু আগের অর্থ থেকে কত আদায় হলো সেটা উল্লেখ থাকে না। এটা ৭-৮ হাজার কোটি টাকা বেশি হবে বলে মনে করি না। তিনি আরও বলেন, মূলত অ্যাসেসমেন্টের কারণে অনাদায়ি করের সৃষ্টি। আর অনাদায়ি কর আদায়ের সর্বোত্তম পন্থা হলো করদাতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বাড়ানো। তাদের সুযোগ দিয়ে কর আদায় করে নেওয়া।

আরেক সাবেক সদস্য আমিনুল করিম বলেন, অনাদায়ি করের হিসাব কতটুকু সঠিক তা দেখার বিষয়। বিভিন্ন মামলায় কর আটকে থাকলেও সেটা অনাদায়ি হিসাব করা হচ্ছে।

কিন্তু আপিল-মামলার পর কর অফিসের পক্ষে রায় পাওয়া মামলাগুলোকে অনাদায়ি হিসাবে বিবেচনা করা উচিত। তিনি আরও বলেন, ৮-৯ বছর আগের অনাদায়ি কর আদায় করা কঠিন। তবে এডিআর শক্তিশালী করা গেলে কিছুটা হলেও কর আদায় সহজ হতো। সূত্র-যুগান্তর।

বার্তাবাজার/এসজে

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর