পুরুষ ও হিজড়া ধর্ষণের বিচার পেতে বাঁধা কোথায়?

বাংলাদেশে কোন পুরুষ এবং হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ধর্ষণের শিকার হলে, সেটাকে আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় অপরাধ হিসাবে দেখা হয় না-এই অভিযোগ তুলে সংশ্লিষ্ট আইনকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে।

রিট আবেদনকারীরা বলেছেন, দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞায় কোন পুরুষের হাতে নারীর ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনাকেই শুধু ধর্ষণ অপরাধ হিসাবে বলা হয়েছে।

সেকারণে পুরুষ এবং তৃতীয় লিঙ্গের কেউ ধর্ষণের শিকার হলে তারা বিচার পাচ্ছে না বলে তারা মনে করেন।

তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আইনে সুনির্দিষ্টভাবে পুরষের ধর্ষণের কথা বলা না থাকলেও অন্য ধারায় অপরাধ হিসাবে বিচার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

পুরুষ এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের ওপর যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের ঘটনাকে আইনে সুনির্দিষ্টভাবে ধর্ষণ অপরাধ হিসাবে যুক্ত করার আবেদন জানানো হয়েছে রিট মামলায়।

একজন মানবাধিকার কর্মী এবং সুপ্রিমকোর্টের দুইজন আইনজীবী এই রিট করেছেন।

তাদের মধ্যে মানবাধিকার কর্মী ড: সৌমেন ভৌমিক বলেছেন, তারা দুই বছর ধরে গবেষণা করে দেখেছেন, ১৬ বছরের বেশি বয়সের পুরুষ এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ধর্ষণের শিকার হলে তারা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না এবং তখন ক্ষতিগ্রস্তরা ঘটনা প্রকাশ করতেও চান না।

ড: ভৌমিক বলেছেন, গত ডিসেম্বর মাসেই পুরুষ এবং ছেলে শিশুর প্রতি ধর্ষণের ২৪টি ঘটনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সচরাচর এ ধরনের বেশির ভাগ ঘটনাই প্রকাশ হয় না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

“বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে যে, অনেক বালক এবং পুরুষ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে অথবা বলাৎকারের শিকার হচ্ছে। কিন্তু তারা কোন বিচার পাচ্ছে না। কারণ আমাদের আইনে অনেক সমস্যা আছে” বলেন তিনি।

নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার পাশের একটি এলাকা থেকে একজন যুবক জানিয়েছেন, একটি মেসে থাকতে গিয়ে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন তিন বছর আগে। কিন্তু তিনি একজন আইনজীবীর কাছে পরামর্শ চাইলে ধর্ষণের বিচার পাওয়া যাবে না বলে তাকে জানানো হয়।

তখন তিনি আর আদালতের আশ্রয় নেননি। তিনি ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনাটিই শেষপর্যন্ত গোপন রাখার চেষ্টা করেছেন।

রিট আবেদনের পক্ষের আইনজীবী তাসমিয়া নুহাইয়া আহমেদ বলেছেন, আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় কোন নারীর ধর্ষণের ঘটনাকেই শুধু ধর্ষণ অপরাধ হিসাবে বলা হয়েছে। সেজন্য তারা এই বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন।

তিনি বলছেন, ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধিতে ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা যেভাবে দেয়া হয়েছে, সেখানে শুধুমাত্র একজন পুরুষ কর্তৃক নারী যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখনই সেই ধর্ষণ অপরাধ বলে গণ্য হবে বলে বলা হয়েছে।

“আমরা বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখছি যে, ঘটনাগুলো কিন্তু এর বাইরেও বিভিন্নভাবে ঘটে। যেমন একজন পুরুষ কর্তৃক একজন পুরুষ ধর্ষণের শিকার হন বা একজন পুরুষ কর্তৃক শিশুদের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। একজন নারী দ্বারা অন্যের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এছাড়া হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও ধর্ষণের শিকার হন। এই বিষয়গুলো আইনে নেই। ফলে এসব ঘটনা আমরা আইনের আওতায় আনতে পারি না,” মন্তব্য করেন আইনজীবী তাসমিয়া নুহাইয়া আহমেদ।

আইনজীবীরা এটাও উল্লেখ করেন যে, “বাংলাদেশে ধরেই নেয় হয় যে ‘পেনিট্রেশন’ মানে নারীর যৌনাঙ্গে পুরুষের যৌনাঙ্গ প্রবেশ করানো। ফলে পুরুষ বা অন্য লিঙ্গের মানুষের বিচার পেতে এটি মূল বাধা হয়ে রয়েছে।”

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বালক বা ছেলে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন বা বলাৎকারের ঘটনাগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বিচার হচ্ছে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ১৬ বছরের বেশি বয়সের পুরুষের ওপর যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের অপরাধের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট আইনে অন্য ধারায় বিচার হচ্ছে।

“পুরুষের সাথে যদি কোন ইন্টারকোর্স হয়, তাহলে সেটা দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় কাভার করে। ৩৭৭ ধারায় এরকম আনন্যাচারাল যৌন সম্পর্ককেই অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়। সেজন্য আলাদাভাবে এটাকে ধর্ষণের সংজ্ঞায় আনতে হবে বলে আমি মনে করি না।”

মন্ত্রী আরও বলেছেন, “ধর্ষণ হিসাবে আখ্যয়িত নয় বলে এটা অপরাধ না-এমন কথা যে বলা হয়, এই যুক্তিটা সঠিক নয়। কারণ ৩৭৭ ধারায় এটা একটা অপরাধ।”

কিন্তু সরকারের ব্যাখ্যার সাথে একমত নন মানবাধিকার কর্মী এবং আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন বলেছেন, “দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় কিন্তু বলা হচ্ছে, ‘অ্যাগাইনস্ট দ্য নেচার’। সুতরাং প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যদি কোন ধরনের যৌনাচার হয়, সেটাকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হবে। সেটা অনেক কিছুই হতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, “বিষয়টি ঠিকমত সংজ্ঞায়িতও করা হয়নি যে আসলে আনন্যাচারাল অ্যাকটিভিটি বলতে কী বোঝানো হচ্ছে বা কোন্ কোন্ বিষয়কে বোঝানো যায়। যেহেতু এই ধারাটিকে ঠিকমত সংজ্ঞায়িতও করতে পারছি না। এছাড়া এই ধারা থাকার কারণে নারী পুরুষ ছাড়া ভিন্ন লিঙ্গের মানুষ যারা আছেন, তারাও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন,” মনে করেন মিজ ইয়াসমিন।

তিনি মনে করেন, আইনে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকার কারণে অনেক সময়ই অপরাধের ব্যাপারে মামলা হলেও তার গুরুত্ব এবং শাস্তি অপেক্ষাকৃত কম হয়।

আইনমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের যৌন হয়রানির বিষয়টি আইনে সুনির্দিষ্টভাবে ছিল না। এখন বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।-বিবিসি বাংলা।

বার্তাবাজার/এসজে

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর