ডাকসুর বিতর্কিত নেতা যারা

আধুনিক বা ঔপনিবেশিক বা ইউরোপীয় ধাঁচের যে ক’টি বিশ্ববিদ্যালয় ভারত উপমহাদেশে আছে তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। ব্রিটিশ উপনিবেশ তাদের সমাজ কল্যাণ ও উপনিবেশ পরিচালনার জন্য ভারতের বিশিষ্ট জ্ঞান হিতৈষীগণ ও এই মহৎ কর্মে এগিয়ে আসেন। তাঁদের মতামত ও উৎসাহে পূর্ববঙ্গে ১৯২১ সালে ব্রিটেনের অক্সফোর্ডের আদলে ও পাঠ তত্ত্বাবধানে এটি পরিচালনা শুরু করে। অক্সফোর্ডের আদলে পরিচালিত হতো বলেই এটিকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে। এটি যেমন সত্যি, আবার মেধার যোগ্যতায় তখন বিশ্বে খ্যাতিও অর্জন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ। এটিকে তখন সংক্ষেপে ডাসু বলা হতো। ডাসু মুলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের আগ্রহের ফসল। তৎকালীন মহান শিক্ষকদের বার্ষিক সভায় প্রস্তাবনা পেশ করলে ১৯২২-১৯২৩ শিক্ষাবর্ষে একটি প্রস্তাব পেশ হয়। যা পরবর্তীতে ১৯২৫ চুড়ান্ত অনুমোদন পায়।

কিন্তু শিক্ষক পরিষদ একটি খসড়া কমিটি গঠন করে। ডাসুর প্রথম সহ-সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক হন যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (১৯২৪-১৯২৫)। এর পরের বছর অভনী ভূষণ। এভাবেই ডাসুতে শিক্ষক পরিষদের নির্বাচন ও মতামতে ডাসুর নেতা নির্বাচিত হতো।

১৯৫৩-১৯৫৪ শিক্ষাবর্ষে ডাসুর গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ডাসুর নাম পরিবর্তন করে নাম নির্ধারণ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়। তখনো ছাত্রসংগঠনগুলো সংগঠনের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিতো না। বিভিন্ন নাম দিয়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন নির্বাচনে অংশ নিতো।

যেমন ছাত্র ইউনিয়ন প্রগতি নামে প্যানেল করতো, আর ছাত্রলীগ শিখাসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর নাম নির্ধারণ করে নির্বাচন করতো।

এই ডাকসু নেতারাই ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-র শিক্কা আন্দোলনসহ সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যে ৭ বার নির্বাচন হয়েছে তা অনেকের চোখের সামনেই সেই নেতারা বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবস্থান করছে।

মুক্তিযুদ্ধের পুর্বে ডাকসু নেতাদের মধ্যেও এখনো অনেকেই জীবিত আছেন। সক্রিয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছেন।

তো প্রশ্ন হচ্ছে আমার কেন এতো মাথাব্যথা, আমার তো ডাকসু কথা বলা লেখার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে কোন প্রকার যোগ্যতা নেই।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন বাংলাদেশের প্রথম ও প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সন্তানেরাই তো পড়ে।

আমাদের সন্তানেরাই ডাকসুই তো বারে বারে গণমানুষের গণস্বপ্ন পূরণে ভূমিকা রেখেছে। আমাদের সন্তানেরাই ডাসু বা ডাকসুর নেতারা আবার জনদুশমনেও পরিণত হয়েছেন বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে।

মহান স্বাধীনতার পূর্বে ডাসুর নেতা গোলাম আজম ও মৌলভী ফরিদ আহমদ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মাস্টার মাইন্ড হিসাবেও ভূমিকা রেখেছেন। তারা যুদ্ধাপরাধী ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছে। একইভাবে ডাকসুর জি এস কেএম ওবায়দুর রহমান ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও ৩ রা নভেম্বর জেলহত্যার সাথে জড়িত। তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব।

বিএনপি করা তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কিন্তু তিনি জাতির জনক হত্যার অন্যতম সহযোগী।

একইভাবে ডাকসুর নেতাদের মধ্যে অনেকেই ’৭৫-র পরবর্তী সামরিক স্বৈরাচারী সরকারের পদলেহন করেছে, রাজনৈতিকভাবে আদর্শচ্যুত হয়ে ডাকসুকে কলঙ্কিত করেছে।

এর মধ্যে ডাকসুর ফেরদৌস আহমদ কোরেশি ৭৫ পরবর্তীতে জিয়া-এরশাদ ও ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দীনের সময় কিংস পার্টি করে ব্যাপকভাবে মুখরোচক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সম্পাদক, সাংবাদিক।

আ স ম আব্দুর রব ডাকসুর সহ সভাপতি ছিলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অনেক অবদান। স্বাধীনতার পর ক্ষমতা ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কোন্দলের মধ্যদিয়ে জাসদ-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। জাসদের বিতর্কিত ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের বিরুদ্ধে নিয়মিত হঠকারি রাজনীতির কারণে ’৭৫-র প্রেক্ষাপট তৈরি করে। স্বৈরাচার এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে দালালি ও এরশাদের গৃহপালিত ৭০ দলীয় বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। এরশাদের পতনের পর বোরকা পরে পালিয়ে জনরোষ থেকে রক্ষা পান।সম্প্রতি তিনি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের নেতাও হয়েছেন।

একইভাবে ডাকসুর ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না স্বাধীনতার পূর্বে ইসলামী ছাত্র সংঘ, স্বাধীনতার পর জাসদ ছাত্রলীগ, জাসদ থেকে বাসদ, বাসদ ভেঙ্গে মাহবুব-মান্না, আবার আওয়ামী লীগে যোগ দান করেন। এমপি হতে না পেরে ফখরুদ্দিন-মঈন উদ্দীনের সময়ে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিতর্কিতভাবে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে যান। কিছুদিন টক শো করে আলোচনায় এলে গড়েন নাগরিক ঐক্য।

বিএনপি নেতা ঢাকার সাবেক মেয়রের সাথে ফোনালাপ ফাঁস হলে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার্থীর লাশ ফেলার কথা বলেন তিনি। তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে আমেরিকা থেকে এসে গ্রেফতার হন। তিনিও ঐক্যফ্রন্টের নেতা।

একইভাবে বাসদ মান্না গ্রুপের ডাকসুর জিএস জিয়াউদ্দিন বাবলু স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পিটে ছুরি মেরে এরশাদের মন্ত্রী হন। তিনি এখনো এরশাদের সাথে আছেন। সম্প্রতি এরশাদের ভাগনিকে বিয়ে করে আলোচনায় আসেন।

সুলতান মুহাম্মদ মনসুর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্যানেল থেকে ১৯৮৯-৯০ সনে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। তাদের নেতৃত্বে এরশাদের পতন হয়। তিনি আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ থেকে এমপিও নির্বাচিত হন।

ফখরুদ্দিন-মঈন উদ্দীনের সময় মান্নার মতো মনসুরও ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বাস্তায়নে উদ্যোগী হলে একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যান। তিনি পরে ড. কামালের গণফোরামে যোগদান করেন। বিগত নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে আবারও এমপি নির্বাচিত হয়ে সংসদে শপত গ্রহণ করে মূলধারার রাজনীতি করার ইঙ্গিত করেন।

দীর্ঘ ২৫ বছর পর সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া ডাকসু নির্বাচনে উপর্যুক্ত নেতাদের থেকে অধিক বিতর্কিত নেতা হলেন নূরু। আওয়ামী লীগের বিগত সরকারের সময়ে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী ছাত্রদের নিয়ে সংঘটিত কোটা আন্দোলনের অন্যতম নেতা। এই আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ও সন্ত্রাসী আন্দোলন হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি মনে করে। তার সাথে সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ইসলামী ছাত্রশিবিরের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়। সে-ও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সহ সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে।

সে নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে অপরাপর ডাকসু নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘মা’ বলে সম্মোধন করে। আবার গণভবন থেকে বেরিয়ে এসে আবার নির্বাচন চায় নিজেরটা ছাড়া। আবার আর এক কথা বলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেমন মতিয়া, মেনন, তোফায়েলকে নেতা বানিয়েছেন, তেমনিভাবে রব-মান্না-নূরকেও সৃষ্টি করেছে।

তো ইতিহাস থেকে আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীরা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আরো সচেতন হলে জাতির মঙ্গল ও দেশের মঙ্গল।

লেখক : কবি ও নব্বইয়ের সাবেক ছাত্রনেতা

কক্সবাজার।

তথ্যসূত্র :

১. বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস – ড. মোহাম্মদ হান্নান

২. উইকিপিডিয়া

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর