বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের ঘৃণ্যতম বর্বরোচিত নিপীড়ন থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর অর্জন করে মহান স্বাধীনতা। আর এই স্বাধীনতা যুদ্ধে শুধুমাত্র বাংলাদেশের জনগণই নয়, হৃদয়ের পরম অনুভূতি দিয়ে বাংলাদেশিদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন গোটা বিশ্বের সাড়া জাগানো ‘দ্য বিটলস’ ব্যান্ড দলের লিড গিটারিস্ট এবং অন্যতম কণ্ঠশিল্পী জর্জ হ্যারিসন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহান বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের লিভারপুলে। সংগীত তাঁকে নিয়ে গেছে মানুষের হৃদয় আঙিনায়। পাকিস্তানিদের নির্মম, নিপীড়ন ও দুর্দশাকে ১ অগাস্ট ১৯৭১ সালের রবিবার নিউইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে প্রায় ৪০,০০০ দর্শকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কথা বিশ্ববাসীকে তুলে ধরেন। সেখানে তিনি ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি গান গেয়ে শোনান। গানটির বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হলো –

বন্ধু আমার এলো একদিন
চোখভরা তার ধু ধু হাহাকার
বললো কেবল সহায়তা চাই
বাঁচাতে হবে যে দেশটাকে তার
বেদনা যদি বা না-ও থাকে তবু
জানি আমি, কিছু করতেই হবে
সকলের কাছে মিনতি জানাই আজ আমি তাই
কয়েকটি প্রাণ এসো না বাঁচাই
বাংলাদেশ, বাংলাদেশ
দেখছি সেখানে সকলই ধ্বস্ত
কত শত প্রাণ মোর নিঃশেষ
দেখিনি এমন বেদনা অশেষ
তোমরা সবাই দুহাত বাড়াও আর বুঝে নাও
মানুষগুলোকে সহায়তা দাও
বাংলাদেশ, বাংলাদেশ
দেখিনি কখনো এত দুর্ভোগ
দোহাই তোমরা ফিরিওনা মুখ, বলো এই কথা
মানুষগুলোকে দেব সহায়তা
বাংলাদেশ, বাংলাদেশ
মনে হবে সে তো কোন সীমানায়, আমরা কোথায়
কী করে বা একে ছুড়ে দেই ফেলে
এত যে বেদনা রাখি দূরে ঠেলে
দেবে না তোমরা ক্ষুধিতকে রুটি সামান্য দুটি
মানুষগুলোকে সহায়তা দাও।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে ও পাকিস্তানিদের নির্মম গণহত্যার প্রতিবাদে, একইসাথে শরণার্থীদের আর্থিক সহযোগিতা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাহায্যার্থে সেই সময়ের সারা বিশ্ব কাঁপানো সংগীত শিল্পীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই কনসার্টের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেতার সম্রাট রবি শংকর। তাঁর এ মহান উদ্যোগ শুধুমাত্র আর্থিক সহযোগিতাই নয়, বাংলাদেশের সুমহান মুক্তিযুদ্ধকে করেছে আরো গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত। ১৯৭১ এর নয় মাসব্যাপী বাংলাদেশে ঘটিত গণহত্যার কথা, লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর তীব্র যন্ত্রণার কথা ফুটে উঠেছে ‘বাংলাদেশ’ নামক গানের মাধ্যমে আর এরই ধারাবাহিকতায় ইউনিসেফ জর্জ হ্যারিসনের অবদানের স্মরণে একটি বিশেষ ফান্ড গঠন করে, যার নাম দেওয়া হয় ‘দ্য জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফ’।

‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ থেকে ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করে জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহায়তার জন্য পাঠান। ইউনিসেফের মাধ্যমে তা ভারতের বন্দিশিবিরে অপুষ্টির শিকার শিশুদের খাবার ও চিকিৎসার জন্য ব্যয়

করা হয়। উল্লেখ্য যে, সে সময় এই কনসার্টে অংশ নেন পন্ডিত রবি শংকরের সঙ্গে বিশ্বখ্যাত সরোদ শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খান ও কিংবদন্তি তবলিয়া ওস্তাদ আল্লারাখা।

জর্জ হ্যারিসন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এক ও ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। কনসার্ট ফর বাংলাদেশের মাধ্যমে জর্জ হ্যারিসন একটা আত্মিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের সাথে। ১৯৭১ এর পাক হানাদার বাহিনীর নারকীয় তান্ডব আর হত্যাযজ্ঞ তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। এ প্রসঙ্গে হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়া বলেছিলেন, ‘জর্জের কাছে শুনেছি, একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধ্বংস আর হানাহানি বিপর্যস্ত করে তুলেছিল রবি শংকরকে। এ নিয়ে মনঃকষ্টে ছিল সে। অন্যদিকে নিজের রেকর্ডিং নিয়ে ব্যস্ত ছিল জর্জ। সত্তরে বিটলস ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে ক্যারিয়ার গড়তে সে মনোযোগী হয়ে ওঠে। এ সময় রবিশংকর জানায়, বাংলাদেশের জন্য তহবিল সংগ্রহে একটি কনসার্ট করতে চায়। এ উদ্যোগে সে জর্জকে পাশে পেতে চায়। জর্জের ও মনে হলো এ কাজে তাঁর নিযুক্ত হওয়া উচিত। তাঁর ডাকে অনেকে সাড়া দিবে, একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোর মাঝামাঝি সময়ে ওই কনসার্ট আয়োজন সময়োপযোগী ছিল। জর্জ তখন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, রিংগো স্টার, লিওন রাসেল, ওস্তাদ আলী আকবর, ওস্তাদ আল্লা রাখা ও রবি শংকরকে নিয়ে কনসার্ট আয়োজন করে। ওই কনসার্ট দিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে জর্জের বন্ধন শুরু হয়’।

১৯৭১ সালের জুলাই মাসে জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ‘গানটি ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলসের ‘দ্য রেকর্ড প্লাট’ নামের স্টুডিওতে ধারণ করা হয়েছিল। ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর ঠিক তিন দিন আগে ওই মাসের ২৮ তারিখ গানটি রিলিজ করা হয়। জর্জ হ্যারিসনের সাথে এই গানটির সহ প্রযোজক ছিলেন মার্কিন বিখ্যাত প্রযোজক, সংগীতশিল্পী ও গীতিকার হার্ভি ফিলিপ স্পেক্টর। মূলত তিনি ফিল স্পেক্টর নামে পরিচিত ছিলেন, মার্কিন সংগীতশিল্পী লিওন রাসেল, সেক্সোফোন বাদক জিম হর্ন এবং ড্রামার জেমস লি কাল্টনার গানটি ধারণে সহায়তা করেন। আরো সহায়তা করেন ব্রিটিশ সংগীতশিল্পী ও এক সময়ের দ্য বিটলস ব্যান্ডের ড্রামার রিংগো ষ্টার। জর্জ হ্যারিসন আটটি গান গেয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের শেষ পরিবেশনা ছিল অবিস্মরণীয় ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ গানটি। ২০০৫ সালে নতুন করে প্রকাশিত হয়েছে দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ অ্যালবামের ডিভিডি। দুটি ডিভিডির এক সেট এখনো পাওয়া যায়। একটি সিডিতে রয়েছে পুরো গানের অনুষ্ঠান। আরেকটিতে রয়েছে শিল্পী-কলাকুশলীদের সাক্ষাৎকার, আর সেখানে রয়েছে কনসার্টি আয়োজনের নেপথ্য কাহিনী। পুরো কাজটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অলিভার হ্যারিসন।

এছাড়া আছে মহড়ার কিছু ছবি ও গান। সঙ্গে আছে একটি সচিত্র পুস্তিকাও। নতুন ডিভিডি সম্পর্কে পন্ডিত রবি শংকর বর্ণনা করেছেন এভাবে- ৭৫ বছরের সংগীতজীবনে যত কনসার্ট করেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। নতুন ডিভিডিতে এক সাক্ষাৎকারে এরিক ক্ল্যাপটন বলেছেন, এ অনুষ্ঠান সারা জীবনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি আরো বলেন, সংগীতশিল্পী হওয়াটা যে গর্বের একটা বিষয়, তা সেই মুহূর্তে বুঝেছিলাম। রিঙ্গো স্টার বলেন, অনুষ্ঠানটি যেন অনন্য সাজে সেজেছিল। দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিল অনেক। এককথায়, ‘বাংলাদেশ’ গানটিই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের জন্য প্রথম কোনো চ্যারিটি সংগীত। গানটিকে বলা হয় ‘সংগীতের ইতিহাসের অন্যতম নিবিড় সামাজিক বক্তব্য’। ২০০৫ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান কনসার্ট ফর বাংলাদেশের জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ গান সম্বন্ধে বলেছিলেন, গানটির মধ্যে যে হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য উঠে এসেছে, তা বাংলাদেশের সংকট সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে স্পর্শ করেছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে ও একইসাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে জর্জ হ্যারিসন ও তাঁর ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ গানটি আরো বাঙময় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এক অবিচ্ছেদ্য গাঁথায় ও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে যুগের পর যুগ। পাশাপাশি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ গানটি বিশ্ব চ্যারিটি প্রথম সংগীতের মর্যাদা আবহমান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বার্তাবাজার/পি

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর