১৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে মরহুম আব্দুল মোতালেব এর স্বপ্ন পূরণ

শেখ আমিনুর হোসেন, সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: বলছি মরহুম আব্দুল মোতালেব সাহেবের কথা। আমরা অধিকাংশই তাঁকে চাচা বলে সম্বোধন করতাম। ভাবতে আমার বেশ অবাক লাগে।

একজন মানুষ তাঁর নিষ্ঠার সাথে কৃতকর্মের মধ্য দিয়ে কিভাবে সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে তা মোতালেব চাচাকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন তারাই খুব ভালো বুঝতে পারবেন। তার চৌদ্দ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কুমিরা মহিলা ডিগ্রী কলেজ সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও তার স্মরণসভা পালিত হবে। আমরাও সবাই তাঁকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।

ক্ষণজন্মা এই অমৃতের সন্তানরা যেন যুগে যুগে সমাজে আবির্ভূত হন সমাজকে কিছু দেওয়ার জন্য। তিনি প্রায়শই একটা কথা বলতেন “মসজিদ হলো আল্লাহর ঘর আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো নবীর ঘর। আমি তাই নবীর ঘর প্রতিষ্ঠা করতে সর্বদা সচেষ্ট।” অসম্ভব স্মরণ শক্তি সম্পন্ন এই মানুষটি জীবনে প্রায় শতশত প্রাইমারী স্কুল, হাই স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজ সহ অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে বিশেষ করে সাতক্ষীরা জেলাতে শিক্ষা প্রসারের আলোক বর্তিকা ও পথিকৃৎ হিসাবে সমাজে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তাইতো অনেকে আবেগে তাঁকে দক্ষিণ বাংলার শিক্ষামন্ত্রী বলে অভিহিত করতেন। এর মধ্যে নারী শিক্ষা প্রসারের প্রতি ওনার দৃষ্টি ছিল অত্যাধিক। এ বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ঊনত্রিশটা নিয়ামকের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত কলেজ গুলোর র‌্যাঙ্কিং করেছে। সেখানে কুমিরা মহিলা কলেজ খুলনা বিভাগের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সম্মাননা ও পদক পেয়েছে। এই পদক পুরস্কার যেন মোতালেব চাচার ললাটে জয় তিলক। এ সম্মান যেন মোতালেব সাহেব-এর কৃতকর্মের সম্মান ও স্বীকৃতি চাচাকে আজ ভীষণ মনে পড়ছে। তাঁর একাগ্রতা, লৌহ-কঠিন মানষিকতা।

তিনি রাজনীতিকদের মতো রাজনৈতিক কর্মকান্ড করতেন না বটে তবে তিনি রাজনীতিকদের চেয়ে অনেক বেশী করে ফেলেছিলেন। অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অন্ধকারাচ্ছন্ন, কুপমন্ডুকতা সমাজে একদিকে অন্ধকার দূরীভুত করে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছিলেন। অন্যদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারের অভিশাপ ঘুচিয়ে সুস্থ্য-স্বাবলীল-সৃজনশীল জীবন দান করেছেন। ফলে সমাজ দুই দিক থেকে উপকৃত হয়েছে। তাইতো তিনি রাজনীতিকদের শিক্ষাগুরু, প্রগতিশীল সমাজ সংস্কারক ও সাতক্ষীরার নবজাগরণের পুরোধা। মোতালেব চাচা চলতেন “আমার অবিধানে ‘না’ বলে শব্দ নেই। অনেক কাজে প্রয়োজনে তিনি দৃঢ় কমান্ড করতেন। তার প্রতিষ্ঠানে চাকরী করা আমাদের মধ্যে কখনো কখনো উষ্মাবোধ, বিরক্তি এগুলো যে হতো না এমন না।

কিন্তু কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পরে, এর সুফল পেলে আমরা সবাই বুঝতাম তাঁর এই কমান্ডের কত প্রয়োজন ছিল। তিনি অত্যন্ত দুরদর্শী চিন্তার মানুষ ছিলেন। তিনি সঠিক সময়ে কাজটি সঠিকভাবে না করলে সেই এলাকার জনগোষ্ঠী অনেকখানি পিছিয়ে যেত। তাই তিনি ছিলেন অসম্ভবের সম্ভবপর ও অবাস্তবের বাস্তব সম্পন্ন একজন মানুষ হিসাবে। প্রকৃতভাবে তিনি ছিলেন প্রগতিশীল। নেতিবাচক মনোভাব বা পশ্চাদ পদসরণ তিনি কখনো মাথায় আনতেন না। যা হওয়া সম্ভব তা হতেই হবে এই ছিল তাঁর দর্শন। সমাজকে কিছু দেওয়ার জন্য যারা জন্মান তাঁদের যেন আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা, নিজের পরিবার-পরিজনবোধ থাকতে নেই।

এসব ক্ষেত্রে তাঁরা বরাবরই থাকেন উদাসীন, উদারনৈতিক। সামগ্রিক স্বার্থই যেন তাঁদের স্বার্থ। সামগ্রিক উন্নয়নই যেন তাঁদের পরিবারের উন্নয়ন। মোতালেব চাচা এই ধাঁচের মানুষ ছিলেন। নিজের পরিবার-পরিজন-স্বার্থবোধ, আত্মকেন্দ্রিকতা ইত্যাদি নিয়ে তিনি খুব বেশী ভাবতেন না। ছিলেন অনেকখানী উদাসীন, উদারনৈতিক। অনেক সময় তাঁর সন্তানদের আক্ষেপ করে বলতে শুনেছি “আব্বুজীর আমাদের নিয়ে ভাবার সময় কোথায়।” যারা সমাজের সন্তান ও পরিবারের সাথে নিজের সন্তান ও পরিবার-পরিজনকে একাকার করে ফেলতে পারেন, প্রকৃতঅর্থে তারাই উদারনৈতিক ও প্রগতিশীল সমাজকর্মী।

সত্যিকার অর্থে মোতালেব সাহেব ছিলেন সেরকমই একজন মানুষ। আমরা তাঁর শিক্ষাটাকে পাথেয় করে রাখতে চাই। তিনি সীমান্তবর্তী, উপকূলবর্তী সাতক্ষীরা জেলাটাকে সমৃদ্ধ ঘটাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য এবং গণমানুষের জন্য রেডক্রস থেকে বেশী বেশী বরাদ্ধ আনতে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। তাঁর পরিচিত আপনজনদের এবং প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিজের ছোট ভাই বা সন্তানসম জ্ঞানে জানতেন। প্রয়োজনে তাদের চোখ রাঙিয়ে বকুনী দিয়ে শাসন করেছে আবার আদর করে সকল সুখ-দুঃখ-বেদনার ভাগী হয়েছেন।

তাই তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের জন্য নিরন্তর ঢাকায় ছুটেছেন অকেশে। অবসাদ ও প্ররোচনা তাঁকে পিছু টানেনি। তাঁর শিক্ষকদের সম্পর্কে কেউ কটুক্তি করলে তার আর রক্ষে নেই। এভাবে বাহু দিয়ে সবাইকে নিজের করে আগলে রাখতেন। গায়ে এতটুকু যেন আঁচড় না লাগে। কত নিন্দুকরা তাঁকে কটুক্তি করেছেন। মহৎ কাজটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি ভ্রুক্ষেপ করতেন না। স্কাউটসে গণমানুষের জন্য বিশেষ অবদান রাখায় তাঁকে একবার ‘রৌপ্য ইলিশ’ সম্মাননা পদক প্রদান করেন কর্তৃপক্ষ। সেই উপলক্ষে কুমিরা মহিলা কলেজে তাঁকে সম্বর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি শিশুর মতো ডুগরে কেঁদে ফেলেছিলেন।

অনুষ্ঠানে সম্বোর্ধিত ব্যক্তির ভাষণে তিনি বলেছিলেন “মানুষের জন্য আন্তরীকভাবে কিছু করলে তার স্বীকৃতি আসলে পাওয়া যায়।” উপস্থিত সকলে খুবই উজ্জীবিত হয়েছিলেন। ‘শিক্ষা’ বিশেষ করে নারী শিক্ষার প্রতি তাঁর অবদানকে সাতক্ষীরা বাসীর কখনো খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। একটি বিষয় তিনি স্বচ্ছা ও স্পষ্ট বুঝেছিলেন যে সমাজে নারীদের অবলা, অপয়া ইত্যাদি বহুদা বিশেষণে রূপায়িত করে তাদের নির্যাতন, নিপীড়ন, বহু বিবাহ, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি করার সুযোগ পায়।

আর তাই সমাজে সৃষ্টি হয় নানা বিপত্তি। সেক্ষেত্রে নারীকে যদি শিক্ষিতা কর্মক্ষম করে গড়ে তোলা যায় তাহলেই সমাজে নারীর মর্যাদা বোধ, স্থিতিশীল, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। বাল্য বিবাহ, বহুবিবাহ, নারীর প্রতি সহিংসতা, এ্যাসিড দগ্ধ, তালাক ইত্যাদি অপসংস্কৃতি গুলি দূর হবে। সমাজে অর্ধেকাংশ নারী হয়ে উঠবে কর্মীর হাতিয়ার। পুরো সমাজ সমৃদ্ধ হবে। সুশিক্ষিত জাতি গঠিত হবে। সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক চর্চার সেবক ছিলেন তিনি। তিনি সাতক্ষীরা জেলা সাংস্কৃতিক অঙ্গণে অনেক গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। সংস্কৃতির নান্দনিকতার ক্ষেত্রে তাঁর জ্ঞান ছিল টনটনে। বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ।

যে কোন অনুষ্ঠানে যদি কোন প্রধান অতিথির সম্বর্ধনা বা তাঁর উপলক্ষে জীবনালেখ্য বা মানপত্র ইত্যাদি ব্যাপার থাকে সেক্ষেত্রে কোন কথা কোথায়, কোন গান কোথায় কখন দিতে হবে তা মোতালেব চাচার কাছ থেকে শিক্ষার ব্যাপার ছিল। ব্যক্তি জীবনে ভীষণ পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন, মার্জিত মানুষ ছিলেন। প্রতিদিন রাত্রে ১টা ১.৩০ টায় দৈনিক কাফেলা’র প্রুফ দেখেই তারপর ঘুমাতো। সকালে ঘুম থেকে উঠে সেভ হয়ে গোসল সেরেই বাহিরে বের হতেন। পরণে ফুল শার্ট-টাই-জুতা মোজা।

যাকে বলে ওয়েলফিট অনেকের ধারণা ছিল অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে অনেক টাকার মালিক হয়েছেন বা অনেক কিছু করেছেন। বাস্তবে অনেকখানি তা সত্য নয়। আমার জানা মতে তাঁর নীতি ছিল যতকে আয় ততকে ব্যয়। প্রয়োজন মতো শিক্ষকদের কাছ থেকে যা নিয়েছেন ডি.জি বোর্ড এই সমস্ত সরকারী প্রতিষ্ঠানে তা দুহাতে মুঠো মুঠো ছড়াতেন। তাই তাঁর কাজ কোথাও আটকে থাকতো না। সরকারী অফিসে ঢুকলে তাঁকে স্যার, স্যার সম্বোধনে সালাম ঠুকতে ঠুকতে সবাই অতিষ্ঠ করে ফেলতো।

আমার জানা মতে তিনি অসুস্থ হলে তাঁর জমি বিক্রি করে চিকিৎসার ব্যয়ভার যোগাতে হয়েছে। কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর চিকিৎসা বাবদ আর্থিক অনুদানও সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। অনেক অসমাপ্ত কাজ রেখে, অনেক স্বপ্নের নির্দেশনা দিয়ে, সবাইকে কাঁদিয়ে ২০০২ সালে ২রা জুন না ফেরার দেশে চলে গেলেন। সাতক্ষীরার আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র কক্ষচ্যুত হলো।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর