দেড় হাজার মানুষের একটি ঘর!

২৪ বছরের প্রতিবন্ধী যুবতী রোজিনার, গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বছর দুই আগে প্রভাবশালীরা ধর্ষণের অপবাদে জোরর্পূবক তাকেসহ তার পরিবারকে উচ্ছেদ করে দেন। গৃহহীন এই যুবতী ঘর বাঁধেন কুমিল্লা রেলস্টেশনের এক কোণে। দু:খ-সুখ মিলিয়ে পাতেন নতুন ঘর। মা ভিক্ষুক আর বাবা রিকশা চালিয়ে দু’মুঠো খাবার জোটান। প্রতিবন্ধী বলে কেউই তাকে তেমন একটা দাম দেয় না ।

তপুর মিয়া। ৫ বছরে চলে গেলেন বাবা। রেলওয়ে পয়েচ ম্যানের চাকরি করতেন তিনি। বেশ কিছুদিন পর চলে গেলেন তপুরের মা ও। মা মারা যাওয়ার পর তপুরের সৎ মা তপুরের বাবার চাকরির পেনশন আর জায়গা সম্পত্তি সব নিয়ে চলে যায়। শেষ বাসস্থান রেলওয়ের কলোনিও ছাড়তে হয় তপুরকে। স্ত্রী আর এক ছেলে নিয়ে তপুরের একমাত্র ঘর এখন কুমিল্লা রেলস্টেশনের একটি গলিতে। কিছুদিন পর তপুরের স্ত্রীও ছেড়ে যায় তাকে। তারপর থেকে তপু একমাত্র সঙ্গী সাত বছরের ছেলে তানিম আর ছোট ভাই রিশাত।

মো. শাহাবুদ্দিন। থাকতেন নোয়াখালীতে। ১৫ বছর ধরেই তার বসবাস কুমিল্লা স্টেশনে। একবার এক্সিডেন্টে পা হারান তিনি, তারপর ছেড়ে চলে যায় স্ত্রী-পুত্র সবাই। এখন যেখানে তার রাত, সেখানেই তার রাত্রিযাপন। তবে স্টেশনেই থাকেন বেশির ভাগ সময়। যেন এ তার নিজেরই ঘর।
রানা বাড়ি মুরাদপুর। শুধু নামটাই মনে আছে তার। কোথায় বাবা কোথায় মা জানেন না রানা নিজেও। ৩২ বছরের এই যুবকের বাসস্থান ও স্টেশনেই।

মুসলেম উদ্দীনের বয়স ৫০। কিন্তু তার এক যুবতী স্ত্রী আছেন। তার বয়স বেশি হলে ৩০ হবে। তাদের দীর্ঘদিন ধরে চিনেন এমন একজনকে জিজ্ঞাসা করলে জানা যায়, তারা দুজনেই ভিক্ষা করে। গত কয়েকদিন আগে বিয়ে করেন। বয়সের এই তারতম্যের কথা জিজ্ঞাসা করলে ওই ব্যক্তি বলেন, বৃদ্ধ দেখে বেশি টাকা দেয় মানুষ, যার কারণে কম বয়সী ভিক্ষুকরা বেশি বয়সী ভিক্ষুকদের বিয়ে করেন। আর বৃদ্ধ হওয়ার কারণে চলাফেরায় সমস্যা হয় বলে তারা বিয়ে করেন কম বয়সীদের, যেন তাদের সাহায্য করতে পারে। তবে তাদের দু’জনেরও ঘর-বাড়ি সবই এখন রেলওয়ে স্টেশন।

রোজিনা, মুসলেম, রানা, শাহাবুদ্দিন, তপুরের মতো প্রায় দেড় হাজার গৃহহীন মানুষের বসবাস ১২৫ বছরের পুরোনো এই রেলওয়ে স্টেশন ও তার আশে পাশের এলাকায়। কেউ দিনে থাকছেন রেলওয়ে স্টেশনে রাত কাটছেন শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ,আবার কেউ দিনে থাকছেন শহরের অন্য প্রান্তে এই দেড় হাজারের মধ্যে পুরুষ প্রায় আটশ আর নারী প্রায় তিনশ। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ প্রায় সত্তর জনের কাছাকাছি, আর শিশু রয়েছে দুইশ পঞ্চাশ জনের মতো। যাদের নেই কোন শিক্ষা ব্যবস্থা। কথা বলার বয়স হলেই তাদের ভিক্ষুক হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে গেলে তারাই তাদের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এভাবে তারা বড় হয়। অশিক্ষিত এই শিশুদের কেউ কেউ চুরি-ছিনতাইয়ের সাথেও জড়িত হয়ে যায়। আবার কেউ খেটে খায়।

তবে মাঝেমাঝে বিভিন্ন মানবিক ও পথ শিশুদের সংগঠন তাদের স্টেশনেই পড়ায়। অস্থায়ী এই শিক্ষা ব্যবস্থাই তাদের একমাত্র শিক্ষাব্যবস্থা। এই শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করে শহরে বিভিন্ন কলেজ ভার্সিটি শিক্ষার্থীরা।

স্থানীয়ভাবে তাদের সবাইকেই কাঙালি বলে ডাকা হয়। স্টেশন সংলগ্ন খালি জায়গাগুলো তাদের রাতের ঘুমানোর স্থান। বর্ষায় বৃষ্টিতে ভিজে আর শীতে কাঁপতে থাকাই তাদের বারোমাসের রুটিন। কর্মহীন এই মানুষগুলো খাদ্যের যোগান দিতে কখনও ভিক্ষা করেন আবার কখনও হকার। কেউ কেউ আবার রিকশা, ভ্যান অটোরিকশা চালিয়ে কোনমতে ভাত জোটান। আবার মাঝে ব্যক্তি বা সংগঠন থেকে প্রাপ্ত খাবারের কারণে চলে তাদের পেট। এই রকম এক সংগঠনের নাম মানবাধিকার সাহায্য সংস্থা(মাসাস)। যারা প্রতিদিন মাত্র ৬০-৭০ জনের খাবার বিতরণ করেন মাত্র ২ টাকার বিনিময়ে। এখানকার নারীরা দিনের বেলায় ভিক্ষাবৃত্তি করেন বা ফ্লাট বাসায় কাজ করেন। আবার কেউ হোটেল বা রেস্টুরেন্টে থালাবাসন মাজার কাজ করেন।

কাঙালিদের মধ্যে একজন জানান, এই দু’হাজার মানুষের বেশিরভাগই মুসলমান। হিন্দুও আছে, তবে পরিমাণে কম। এই কাঙালিদের স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া, কিন্তু ছেলেমেয়েদের স্বপ্ন রেলস্টেশনেই দমে যায়।

স্টেশনের পাশের দোকানদার হারুনর রশীদ জানান, এরা দীর্ঘদিন এখানে থাকলেও তারা ময়মনসিংহ, রংপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে এই স্টেশনে থাকে। বাস্তুচ্যুত এই মানুষদের নেই স্থায়ী কোন বাসস্থান না আছে এদের অপসারণের কোন সরকারি উদ্যোগ। এরা যেমন দখল করে রেখেছেন স্টেশনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, তেমনই প্রতিনিয়ত যাত্রী, স্টেশন কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সাথে কোন না কোন কারণে ঝামেলা বাধিয়ে দেন। আবার নোংরা করে রাখেন স্টেশনের আশপাশের জায়গা।

বাস্তুচ্যুত এই মানুষের ব্যাপারে স্টেশন মাস্টার সফিকুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, রেলস্টেশনে থাকাকালীন ওদের কারণে অনেক সমস্যা ফেস করি আমরা। মাঝেমাঝে আমাদের কর্মকর্তা,কর্মচারীদের সাথে তারা ঝামেলা করে বসে, এরা স্বাস্থ্যবিধি মানতেই চায় না, আর স্টেশনের পুরো অংশ ময়লা করে রাখে। যাত্রীদেরও অনেক সমস্যা করে। কিন্তু কী করার, এদেরতো থাকার জায়গা নেই! এ ব্যাপারে সরকারের স্থায়ী একটা উদ্যোগ দরকার।

মানবিক সংগঠন পথ শিশু কল্যাণ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় সভাপতি নাজমুল হাসান রাসেল জানান, আমরা ৬০ জনের মতো শিশুকে পড়াই। এর বাইরে আরও প্রায় এক শ পঞ্চাশ জন আছে। এই শিশুগুলোর মধ্যেই অনেকে মাদকের সাথে স¤পৃক্ত হয়ে গেছে। এখানকার শিশুগুলো বড় হলেই মাদকের সাথে সপৃক্ত হয়ে যায়। তাই তাদের স্থায়ী বাসস্থান ও কর্মসংস্থান গড়ে তুলতে হবে। সরকার এই ব্যাপারে উদ্যোগী না হলে বড় হুমকির মুখে পড়বে কুমিল্লা নগরী।

মানবাধিকার সাহায্য সংস্থা (মাসাস) সভাপতি মো. মোসলেম বলেন, আমরা প্রতিদিন ৭০-৮০ জনের খাবার বিতরণ করি। যেগুলো দেওয়ার পরেও অনেক মানুষ বাকি থাকে। আমরাতো সবার চাহিদা পূরণ করতে পারি না। আমরা চাই সবাই এগিয়ে আসুক। আর সরকার এই ব্যাপারে একটা স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।

বার্তাবাজার/এ.এম.আর

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর