দুদকের পরামর্শে স্বাস্থ্যের দুর্নীতি ঠেকাতে ১৬ সুপারিশ

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক প্রতিবেদনে দুর্নীতি প্রতিরোধে ১৬টি সুপারিশ করেছে ।
স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধে প্রতি ৩ মাস অন্তর নৈতিকতা ও শুদ্ধাচার প্রশিক্ষণ দিতে হবে চিকিৎসকদের। পাশপাশি ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখা, ওষুধ কোম্পানি থেকে উপঢৌকন না নেয়া, প্রতি উপজেলা ও ইউনিয়নে স্বাস্থ্য মেলার আয়োজনসহ ১৬ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এতে ওষুধের মজুদ ও সরবরাহ সংক্রান্ত তথ্য রেজিস্টার হালনাগাদ রাখার কথা বলা হয়।

এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে ওষুধ ও মেডিকেল ইকুইপমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরামর্শের আলোকে সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এই সুপারিশমালায় নতুন কোনো বিষয় নেই বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমাম স্বাক্ষরিত এক স্মারকে এই ১৬ দফা সুপারিশ করা হয়। ১৬ নভেম্বর এই সুপারিশ দেশের সব ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল পরিচালকদের পাঠানো হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাদের এই সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমাম বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধে দুদক কিছু সুপারিশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দেয়। সুপারিশগুলোকে মন্ত্রণালয় যদি ব্যবস্থা গ্রহণ নেয় তাহলে দুর্নীতি প্রতিরোধে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি হবে। তার পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে বেশকিছু বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়। তিনি বলেন,এই সুপারিশমালা সব প্রতিষ্ঠানেই পাঠানো হয়েছে। সুপারিশমালা পাওয়ার পর থেকেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বাস্তবায়ন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

দুর্নীতি প্রতিরোধে সুপারিশগুলো হলো-

১. সব সরকারি হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকে জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর ও উন্মুক্ত স্থানে সিটিজেন চার্টার প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

২. ওষুধের মজুদ ও সরবরাহ সংক্রান্ত তথ্য রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ ও হালনাগাদ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। যেখানে অটোমেশনের ব্যবস্থা আছে সেখানে অটোমেশনের মাধ্যমে হালনাগাদ নিশ্চিত করতে হবে।

৩. ওষুধ ও মেডিকেল ইকুইপমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ইজিপি’র মাধ্যমে টেন্ডার আহ্বান করতে হবে। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট (পিপিএ)-২০০৬ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল (পিপিআর)-২০০৮ যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।

৪. সরকারি পর্যায়ের সব স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কোনো ওষুধ কি পরিমাণে আছে তা ডিজিটাল ব্যানারের মাধ্যমে প্রতিদিন জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর স্থানে প্রদর্শন করতে হবে। সব সরকারি হাসপাতালে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার মূল্য তালিকা ডিজিটাল ব্যানারের মাধ্যমে জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর স্থানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে।

৫. সরকারি হাসপাতালে সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের ওপর নজরদারির লক্ষ্যে মনিটরিং টিম গঠন, সিসিটিভির মাধ্যমে তদারকি জোরদার ও পরিদর্শনের মাধ্যমে দালাল উৎখাতের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

৬. প্রাইভেট ক্লিনিক পরিদর্শনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদফতরে অনুমোদন প্রাপ্তি ও আনুষঙ্গিক তথ্য যাচাই নিশ্চিত করে অননুমোদিত স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে।

৭. স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে নকল ওষুধ তৈরির কারখানা চিহ্নিত করে নিুমানের ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে কর্মরত মালিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৮. সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট বদলির নীতিমালা প্রণয়ন করে বদলি পদায়ন ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। প্রশাসনিক পদে কর্মরত কর্মকর্তাদের (সিভিল সার্জন/ইউইউচএন্ডএফপিও) নিজ জেলায় পদায়ন করা যাবে না।

৯. চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন স্পট, পরিচ্ছন্ন ও পাঠযোগ্য করার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ওষুধের নাম ক্যাপিটাল লেটারে প্রয়োজনে কম্পিউটারে টাইপ করে লেখার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করতে হবে।

১০. ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির কাছ থেকে কোনো প্রকার সুবিধা বা উপঢৌকন গ্রহণ করা যাবে না। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের হাসপাতাল থেকে দূরে অবস্থান নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে তারা রোগীদের হয়রানি ও বিরক্তির কারণ না হয়।

১১. রোগীদের জন্য হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষার ব্যবস্থা করা এবং বিশেষ প্রয়োজনে যে পরীক্ষা হাসপাতালে হয় না তা বাইরে করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বা ডায়াগনস্টিকের নাম উল্লেখ বা রেফার করা যাবে না।

১২. সরকারের বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করতে প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে ইউনিয়ন ও কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মীদের সমন্বয়ে মেলার আয়োজন করতে হবে।

১৩. সব চিকিৎসককে উপজেলা পর্যায়ে বাধ্যতামূলকভাবে ন্যূনতম দুই বছর কাজ করতে হবে। অন্যথায় তাদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অনুমতি দেয়া হবে না।

১৪. সব হাসপাতালে জরুরি হটলাইন সেবা চালু করা, পরামর্শ প্রদান ও হটলাইন নম্বর জনগণের দৃষ্টিগোচর স্থানে প্রদর্শন এবং অভিযোগ বাক্স স্থাপন ও অভিযোগ পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সব তথ্য সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে নিজস্ব ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হবে।

১৫. সরকারি অফিস পরিদর্শনকালে সরকারি বরাদ্দবহির্ভূত আপ্যায়ন প্রথা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে।

১৬. চিকিৎসকদের প্রতি তিন মাস অন্তর নৈতিকতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও শুদ্ধাচার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ইনোভেটিভ ও জনসাধারণের সেবা সহজীকরণের জন্য উৎসাহিত করতে হবে। পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক সরকারি হাসপাতালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল, সিটিজেন চার্টার ইনোভেশন এবং তথ্য অধিকার আইন বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন-বিএমএ মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, এখানে যা বলা হয়েছে তা সবই পুরনো গল্প, যা নতুন করে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ওষুধ কোম্পানির লোকদের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। ব্যবস্থাপত্রে ক্যাপিটাল লেটারে লেখার বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে, যা আইন করলেই হয়। আর শুদ্ধাচারের বিষয়টি একটি ভালো উদ্যোগ।

তবে এটি শুধু চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে নয়, সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। শুদ্ধাচার নিচে থেকে ওপরে ওঠে না, তাই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরও শুদ্ধাচার বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।

বার্তাবাজার/এম.এ.আর

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর