রাঙ্গাবালীতে উন্নয়নের নামে প্রতারণা, সঞ্চয় হিসেবে ধুম্রজাল

অতি মুনাফা, কম সুদে ঋণ এবং স্বাবলম্বী করার নামে শুরু হয় প্রতারনা। আর এই প্রতারনার ফাঁদে পা বাড়ায় চরাঞ্চলের নিম্মবিত্ত মানুষ। শুরু হয় সঞ্চয় জমানো। কিন্তু আট মাসের মাথায় গিয়ে সব স্বপ্ন ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে।

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দুর্গম চরমোন্তাজ ইউনিয়নে ‘উন্নয়ন সমাজকল্যান সংস্থ্যা’র প্রতারণার শিকার হয়েছেন এই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।

জানা গেছে, চলতি বছরের ৮-৯ মাস আগে চরমোন্তাজ ইউনিয়নের স্লুইস বাজার একটি ভাড়াটে ঘরে সাইনবোর্ড সাটিয়ে উন্নয়ন সমাজ কল্যান সংস্থার একটি কার্যালয় করা হয়। সঞ্চয়ে বেশি মুনাফা, কম সুদে ঋণ দেয়া ও বিনামূল্যের সেলাই মেশিন দিয়ে কাজ করে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কার্যক্রম শুরু করে সংস্থাটির চরমোন্তাজ ইউনিয়নের সুপারভাইজার পরিচয়দানকারী এইচএম রফিকুল ইসলাম।

ছবি: বার্তা বাজার।

ওই ইউনিয়নের উত্তর চরমোন্তাজ গ্রামের আতাউল হাওলাদারের ছেলে সে। তার নেতৃত্বে মাঠকর্মীরা সদস্য সংগ্রহ করেছে। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, ওই ইউনিয়নে তাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬০০ জন। প্রত্যেককে ১৫০ টাকা ভর্তি ফি দিয়ে সংস্থার সদস্য হতে হয়েছে। আর যে যার সাধ্য অনুযায়ী সঞ্চয় জমা দিয়েছে বলে জানান তারা।
এদিকে, সদস্যের কাছ থেকে সঞ্চয় জমা নিয়ে গত দুই মাস আগে হঠাৎ ওই সংস্থার কার্যালয়ে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় সংশ্লিষ্টরা। সংস্থার সদস্যদের অভিযোগ, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কষ্টে অর্জিত টাকা সঞ্চয় করেছে তারা। কিন্তু সেই টাকা নিয়ে নয়ছয় করছে সংস্থ্যাটি। সরেজমিনে দেখা গেছে, কার্যালয়ের সাইনবোর্ড নেই। তালা ঝুলছে।

এই কার্যালয়ের কার্যক্রম চলা ঘরের মালিক লিভা বেগম বলেন, ‘আমার চার মাসের ভাড়া না দিয়ে মালামাল নিয়ে গেছে। আমি নিজেও সংস্থার সদস্য, আমার দুই হাজার টাকা জমা ছিল। এভাবে প্রত্যেক সদস্যের ১৫০০ থেকে ২০০০ করে টাকা জমা ছিল। আমাদের এই দুই ওয়ার্ডেই প্রায় ১১৫ জন সদস্যের সঞ্চয় নিয়েছে। রফিকের (সুপারভাইজার) কাছে টাকা চাইলে সে উচ্চবাচ্য কথা বলে।’

এদিকে শুক্রবার দুপুরে প্রতারণার শিকার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের ৩ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের শতাধিক সদস্য মানববন্ধন কর্মসূচি করেছেন। তাদের দাবি, অনতিবিলম্বে তাদের সঞ্চয়ের টাকা ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

প্রতারণার শিকার সদস্য সেলিনা, রসোনা, ফাহিমা ও সোনিয়াসহ অনেকেই বলেন, ‘তাদের সঙ্গে রফিক ও সংস্থার অন্যান্য লোকজন প্রতারণা করেছে। সেলাই মেশিন দেওয়ার কথা, ঋণ দেওয়ার কথা। কিন্তু কোন কথাই রাখেনি। উল্টো তাদের সঞ্চয়ের টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না।’

উত্তর চরমোন্তাজ ৬ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা সংস্থার মাঠকর্মী মো. আরিফ হোসেন বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে ৭০ জন সদস্য। অফিসের কার্যক্রম অনেকদিন অফ (বন্ধ)। ভর্তি ফি ও সঞ্চয়ের ২৭ হাজার টাকা উঠিয়ে আমি সুপারভাইজার রফিকের কাছে দিছি। সে বলছে, সঞ্চয়ের একটা টাকা গেলে সে দিবে। কিন্তু এখন সে কোন আমলে নেয় না। ঋণ দিবে সেলাই মেশিন দিবে বলছে। আমি লিংকন ভাইকে (উপজেলার সমন্বয়ক) অনেকবার জানাইছি। সে আমার কাছে বলে আজ আসবে, কাল আসবে বলে আসে না।’

এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সংস্থার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের সুপারভাইজার এইচএম রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ওদের টাকা পয়সার হিসাব কালকে সন্ধ্যায় (শুক্রবার) বসে দিয়ে দেওয়া হইছে। টাকা পয়সা ওদের কাছেই (মাঠকর্মী)। লাল মিয়া মেম্বর, শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক মুছা দফাদার, চরমোন্তাজ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সুমন হাওলাদারের সঙ্গে কথা বললে জানতে পারবেন। ওরা (মাঠকর্মী) যে টাকাটা উঠাইছে, ওই টাকাটা ওরা জমা দেয় নাই। বইয়ের সঙ্গে শীটের মিল নাই।’

প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘৬০০ সদস্য আপনাকে কে বলছে? আমিওতো বলতে পারি একজনও সদস্য নাই। এখন আপাতত ২৩ জনের মত সদস্যকে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া আছে। এছাড়া বাকি যারা সদস্য আছে, সব শেষ। এখন শুধু ঋণ টাকাটা উঠানোর ব্যাপার। এছাড়া কোন কার্যক্রম নেইতো এখানে। মূলত অফিস হলো রাঙ্গাবালী।’

শুধু চরমোন্তাজেই নয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার ছোটবাইশদিয়া, বড়বাইশদিয়া ও চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নে এই সংস্থার কার্যক্রম চলছে বলে জানা যায়। তবে চরমোন্তাজ ছাড়া বাকি ইউনিয়নগুলো নিয়ে এখনও কোন অভিযোগ ওঠেনি। এবিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থার উপজেলা সমন্বয়ক লিংকন শিকদার (আসাদ) বলেন, ‘আমরা সদস্য তৈরি করছি। ওদের কাছ থেকে সঞ্চয় নিছি।

আমাদের সদস্যদেরকে সেলাই প্রশিক্ষণ দিছি। যেই কর্মীর ফিল্ডে সমস্যা হইছে, ওই কর্মী তার বোনকে ঋণ দিছে। তিনমাসে ওই টাকাটা উঠাইতে পারে নাই। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান যেকোন একটা ফান্ডের উপারে চলে। আমাদের ফান্ড পাওয়ার কথা ছিল আরও দুই মাস আগে। করোনা সংকটের পইররা আমাদের ফান্ড পেতে দেরি হইছে। ফান্ড ঢুকবে ডিসেম্বরের ১০ তারিখের মধ্যে। যার কারণে পাবলিক ও কর্মীদের সঙ্গে একটু ঝামেলায় আছি। আশা করছি, ক্যাশ ঢুকে গেলে সব স্বাভাবিকভাবে ফিরে যাইতে পারবো।’

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাশফাকুর রহমান বলেন, এবিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বার্তাবাজার/অমি

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর