‘স্বর্ণ গুরু’ গোল্ডেন শফি এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে

তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নব গঠিত ৪৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। উত্তরার জমজম টাওয়ারের একাংশের মালিক। বৃহত্তর উত্তরার উত্তরখান থানার একচ্ছত্র অধিপতিও তিনি। তার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।”গোল্ডেন শফি” নামে সমাদৃত একজন কুখ্যাত স্বর্ণ চোরাকারবারি। যার উত্থান একজন হকার থেকে হলেও আজ তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক।।

আলোচিত গোল্ডেন মনির গ্রেফতার হওয়ার পর একের পর এক তথ্য আসে প্রশাসনের হাতে। গোল্ডেন মনিরের প্রধান সহযোগী তিনি। তাই তার নামের সঙ্গে মিল রেখে যুক্ত হয়েছে সোনা শব্দটি। সোনা শফি বা গোল্ডেন শফি। একসময় ছিলেন লাগেজ পার্টির সদস্য। বিমানবন্দর এলাকায় একটি হত্যা মামলায় কাস্টমস কর্মকর্তাদের পক্ষে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে জয় করে নেন স্বর্ণের হরিণ। গড়ে তোলেন সোনা ও অর্থ চোরাচালানের বিশাল নেটওয়ার্ক। জিরো থেকে হিরো বনে যান। একসময়ের হকার এখন ঘুরেন কোটি টাকার গাড়ীতে। ঢাকা থেকে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারতে সোনা চোরাচালান করে হয়ে যান কোটিপতি ব্যবসায়ী। শুরু করেন মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার।।

একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ‘গোল্ডেন শফি’ নিজের খোলস পাল্টে হয়ে গেছেন আওয়ামী লীগ নেতা। নির্বিঘ্নে টাকা পাচার করতে ‘শফি অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামে সিভিল এভিয়েশনে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। টানা তিন বছর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার পার্কিং, ময়লা নিষ্কাশন ও কনকর্ড হলের ইজারাদার ছিল এই প্রতিষ্ঠানের।

রাজধানীর উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ মোড়ে ১৪তলা বাণিজ্যিক ভবন জমজম টাওয়ারের অন্যতম মালিক তিনি। নামে-বেনামে শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক এই ব্যক্তি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর।

মোঃ শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিক নামের এই জনপ্রতিনিধিকে রাজধানীর উত্তরা ও উত্তরখান এলাকার সকলেই ‘গোল্ডেন শফি’ নামেই চেনেন। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার চোরাকারবারি ও ভূমিদস্যু মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের প্রধান সহযোগী এই ‘গোল্ডেন শফি’।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এলাকায় ব্যাপক দাপট দেখিয়ে বেড়ানো এই জনপ্রতিনিধি স্থানীয় অসহায় ও নিরীহ মানুষকে মারধর ও লাঞ্ছিত করেন বিভিন্নভাবে। নিরীহ মানুষকে মারধর করেন পান থেকে চুন খসলেই। মনিরের গ্রেপ্তারের পর নাম আলোচনায় আসতেই গা ঢাকা দিয়েছেন তিনি। তাঁর ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করেছে র‌্যাবসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা।

ফাইল ছবি

যেভাবে শফির উত্থান

১৯৯৬ সালের একটি ঘটনা। ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে সুরত মিয়া ওরফে এস মিয়া নামে ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী একজন নাগরিক। তিনি মদ্যপ অবস্থায় অসংলগ্ন আচরণ করেন। একপর্যায়ে তাঁর পেটে কাচের বোতল ঢুকিয়ে দিলে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। এস মিয়ার স্ত্রী সৈয়দা শামসিয়া বেগম ক্যান্টনমেন্ট থানায় তিনজন কাস্টমস কর্মকর্তাকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় কাস্টমসের পক্ষে আদালতে সাক্ষী হন শফি। গোল্ডেন শফি এই সুযোগে আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে জয় করে নেন কাস্টমস্ কর্মকর্তাদের মন।

জনশ্রুতি আছে, ওই সাক্ষ্য দেওয়ার বিনিময়ে তাঁকে সোনা চোরাচালানে সহায়তা দেন ওইসব অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তা। এতে শফি-মনির সিন্ডিকেটের কারবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তাঁদের সঙ্গে সালেহ, রিয়াজ, আলীও ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে যান। অবৈধ টাকায় তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রাজউক ও গণপূর্তের জমি নিজেদের দখলে নেওয়ার মিশনে নামেন। উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ মোড়ে ২০ কাঠা জমির ওপর জমজম টাওয়ার ছাড়াও ১১ নম্বর সেকশনে সাফা টাওয়ারের অংশীদার শফি। এ ছাড়া উত্তরখানসহ আরো কয়েকটি এলাকায় তাঁর বহুতল ভবন আছে।

এছাড়া দেশে-বিদেশে রয়েছে অঢেল সম্পদ। ২০০৭ সালে সোনা চোরাচালানে মামলা হওয়া এবং ২০০৮ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে ভোল্ট পাল্টান গোল্ডেন শফি। ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। একপর্যায়ে বৃহত্তর উত্তরা থানা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক হন। বর্তমানে তিনি উত্তরখান থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তাঁর ‘শফি অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিমানবন্দরের কার পার্কিং ও কনকর্ড হলের ইজারায় ছিল গত তিন বছর। এই সুযোগে সংরক্ষিত এলাকায় অবাধ যাতায়াতের নিরাপত্তা পাস বা “ডি পাস” কাজে লাগিয়ে সোনা ও মুদ্রা পাচার করেছেন নির্বিঘ্নে। অল্পদিনে হয়ে যায় আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ।।

শফির নিয়ন্ত্রণে থাকা জমজম টাওয়ারে তাঁদের অফিস রয়েছে। সেখানে গত তিনদিন ধরে তালা ঝুলছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মনির গ্রেপ্তারের পর রবিবার থেকে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না কাউন্সিলর শফিকে। রবিবার র‌্যাব জমজম টাওয়ারে তল্লাশি চালানোয় অন্য মালিকরাও গাঢাকা দিয়েছেন।

মনিরের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় দায়ের করা তিনটি ফৌজদারি মামলার তদন্ত করছে পুলিশ। আদালতের নির্দেশে ১৮ দিনের রিমান্ডে আছেন তিনি। গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেন, ‘মনিরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে এবং এর পেছনে জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।’ র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেঃ কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘মনিরের অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যে বা যারা জড়িত আছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের ব্যাপারে র‌্যাব অনুসন্ধান চালাবে।’ অপরাধী যত শক্তিশালী হোক না কোন আইনের উর্ধ্বে কেউ নয়।।

একাধিক সূত্র জানায়, উত্তরখানের কাচকুড়া এলাকার শফি নব্বইয়ের দশকে ছিলেন বিমানবন্দর এলাকার হকার। পরে চোরাকারবারির লাগেজ পার্টির সদস্য হন তিনি। এই কাজ করতে গিয়ে গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও সম্পর্ক হয়। সেই সম্পর্কের অশুভ সূত্রে আজ মনির ও শফি দু’জনে হাজার কোটি টাকার মালিক।

ছবি-বার্তাবাজার

কে এই শফী?

বিশেষ সূত্র জানায়, শফিক ওরফে শফি উত্তরখানের কাচকুড়া বেতগী গ্রামের মৃত হাজী ফজন উদ্দিনের ছেলে। তাঁর বিরুদ্ধে উত্তরার দুই থানায় কয়েকটি মামলা আছে। স্থানীয় কাচকুড়া কলেজের এক শিক্ষিকাকে হয়রানি করেন শফিকের ফুফাতো ভাই শ্যামল মিয়া। এ ঘটনায় মামলা হলে কলেজের অধ্যক্ষ জামাল উদ্দিন মিঞাকে লাঞ্ছিত করেন শফিক। ২০১৬ সালের এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন অধ্যক্ষ জামাল উদ্দিন মিয়া। ওই ঘটনায় মামলাও হয়। তবে প্রভাবশালী শফিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হওয়ার পরে এলাকায় আরো আধিপত্য বিস্তার করেছেন তিনি। গতমাসেই গোল্ডেন শফিক ৪৪নং ওয়ার্ড সেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোঃ ফারুক মিয়াকে তার ভাই নাজমুল কর্ত্তৃক মারধর করান। ভয়ে ফারুক শফিকের নামটি উচ্চারণ করার সাহস পাননি। এভাবে দিনের পর দিন শফিক ও তার ক্যাডার বাহিনী কর্তৃক লাঞ্চিত কাচকুড়া এলাকার বহু মানুষ।।

মনিরের অনেক সম্পদই চার চোরাকারবারির সঙ্গে যৌথভাবে করা। এক মাস ধরে মনিরের ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি টের পেয়ে যায় চোরাকারবারি চক্রটি। তখনই কৌশলে উত্তরার জমজম টাওয়ারের মালিকানা ছেড়ে কৌশল পাল্টান গোল্ডেন মনির। এসব কাজে তাঁকে সহায়তা করেন শফি। সূত্র জানায়, জমজম টাওয়ারে হায়দার নামে সিরাজগঞ্জের আরেকজন মালিক আছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজের ঘনিষ্ঠ হয়ে হায়দারও চোরকারবারি সিন্ডিকেটে যোগ দেন।

উত্তরখানবাসীর একটাই দাবী গোল্ডেন শফির অত্যাচারে অতিষ্ঠ তারা। টাকার প্রভাবে এমন চোরাকারবারির পতন চান তারা। এলাকার বিজ্ঞ মহল মনে করেন “গোল্ডেন শফি” ও তার গড ফাদারদের আইনের আওতায় আনা এটাই মোক্ষম সময়। সকলেই গোল্ডেন শফির গ্রেফতার দাবী করেন।

বার্তাবাজার/এসজে

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর