বিস্ফোরণের ৩০ মিনিট আগে এক ‘জঙ্গি’ পুলিশ ভ্যানে বোমাটি রেখে যায়

রাজধানীর মালিবাগে পুলিশ ভ্যানে বিস্ফোরণের ৩০ মিনিট আগে তরুণ বয়সী এক ‘জঙ্গি’হাতে তৈরি বোমাটি রেখে যায়। ওই তরুণের বয়স আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ বছর হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার পিঠে ছিল একটি ব্যাগপ্যাক। রাত ৮টা ১৮ মিনিটে ওই তরুণ পুলিশের গাড়িতে উঠে বোমাটি রেখে নেমে যায়। এর ঠিক ৩০ মিনিট পর ৮টা ৪৮ মিনিটে বোমাটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, এটি ছিল শক্তিশালী ইম্প্রোভাইজ এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস বা আইইডি, যাকে ‘টাইম বোমা’ বলে অভিহিত করছেন তারা। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস বা ইসলামিক স্টেটপন্থী নব্য জেএমবির নতুন একটি গ্রুপ এই বিস্ফোরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে। যাদের লক্ষ্য ছিল এক বা একাধিক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা।

গত রবিবার (২৬ মে) রাত পৌনে নয়টার দিকে রাজধানীর মালিবাগের ফিলিং স্টেশনের বিপরীতে ফ্লাইওভারের নিচে রাখা পুলিশের বিশেষ শাখার একটি পিক-আপভ্যানে বোমাটি বিস্ফোরিত হয়। এতে পুলিশের এক সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) রাশেদা আক্তার, লাল মিয়া নামে একজন রিকশাচালক ও শাহনাজ শারমিন নামে এক পথচারী আহত হন। বিস্ফোরণের ঘটনার পাঁচ ঘণ্টা পর এর দায় স্বীকার করে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস। এ ঘটনায় বিস্ফোরিত হওয়া ওই গাড়ির চালক এসবির কনস্টেবল শফিক চৌধুরী বাদী হয়ে পল্টন থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।

এক মাসের ব্যবধানে খোদ রাজধানীতেই দুটি ঘটনায় পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা হামলার ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তদন্ত করছে পুলিশের একাধিক ইউনিট। যদিও ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া দুটি হামলার পরপরই এগুলোকে ‘শক্তিশালী ককটেল’ বা ‘ইম্প্রোভাইজড ককটেল’ হামলা বলে অভিহিত করছেন, কিন্তু তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আলামত ও অন্যান্য উপকরণ দেখে তাদের মনে হয়েছে সর্বশেষ বোমাটি ছিল একটি শক্তিশালী আইইডি। এতে টাইম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল এবং এটিকে ‘টাইম বোমা’ বলছেন তারা। মঙ্গলবারও (২৮ মে) পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেই রাজধানীতে ককটেল হামলা চালানো হচ্ছে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালেও এমন ভীতিকর পরিস্থিতি আমরা দেখেছি।’একইসঙ্গে তিনি ভয় না পেয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

নষ্ট ও সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল ঘটনাস্থলের আশেপাশের সিসি ক্যামেরা

মালিবাগের বিস্ফোরণের তদন্তের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনার পর তারা ওই এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু যে গাড়িটিতে বিস্ফোরণ হয়েছে সেটিকে সরাসরি দেখা যায় এমন একটি সিসি ক্যামেরা একদিন আগে থেকেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল বলে জানা গেছে। এছাড়া অপর একটি সিসিটিভি ফুটেজে ঘটনার আংশিক দেখা গেছে। ঘটনাস্থলের ফিলিং স্টেশনসহ আশেপাশের আরও কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরাও নষ্ট ছিল বলে জানতে পেরেছেন তারা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, বিস্ফোরণের আগে পুলিশের গাড়িতে ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী এক যুবক উঠে নির্বিঘ্নে বোমাটি রেখে যায়। তার সঙ্গে সন্দেহভাজন আরও কয়েকজনকে দেখা গেছে। তবে তারা ওই জঙ্গি তরুণের সঙ্গেই এসেছিল কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেননি তারা। বোমাটি রেখে ওই তরুণ শান্তিনগর মোড়ের দিকে হেঁটে চলে গেছে।

দুই ঘটনার নেপথ্যে একই গ্রুপ

গত ২৯ এপ্রিল ঢাকার গুলিস্তানে একটি ট্রাফিক বক্সের পাশে একটি হাতে তৈরি বোমা বা আইইডি বিস্ফোরিত হয়, যাতে ট্রাফিক পুলিশের দুই সদস্য ও একজন কমিউনিটি পুলিশ সদস্য আহত হন। জঙ্গিবিরোধী বিশেষায়িত ইউনিট ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম কর্মকর্তারা বলছেন, দুটি ঘটনায় ব্যবহৃত আইইডির উপকরণ প্রায় একইরকম। গুলিস্তানে বিস্ফোরিত বোমাটিতেও টাইমার লাগানো ছিল। তারা ধারণা করছেন, একই গ্রুপের সদস্যরাই দুটি হামলার সঙ্গে জড়িত। এমনকি একই ব্যক্তি বোমাগুলো তৈরিও করছে। তাদের লক্ষ্যও একই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টার্গেট করছে তারা। যদিও গুলিস্তানে পুলিশকে লক্ষ্য করে বিস্ফোরণের ঘটনায় এখনও কাউকে শনাক্ত করতে পারেননি তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মতিঝিল জোনের একজন কর্মকর্তা জানান, তারা প্রযুক্তির সহায়তায় নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাদের পাশাপাশি কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটসহ অন্যান্য সংস্থাও ঘটনাটি তদন্ত করছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোনও অগ্রগতি এখনও হয়নি।

গুলিস্তানে বোমা হামলার ঘটনার পর পুলিশি তল্লাশি। (ফাইল ছবি)

নেপথ্যে কারা?

কাউন্টার টেরোরিজম কর্মকর্তারা বলছেন, আইএসের দায় স্বীকারসহ হামলার ধরন, টার্গেট নির্ধারণ বিশ্লেষণ করে তারা মনে করছেন এর সঙ্গে আইএসপন্থী বাংলাদেশি জঙ্গি গ্রুপ নব্য জেএমবি সম্পৃক্ত। ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্তোরাঁয় হামলার পর ধারাবাহিক জঙ্গিবিরোধী অভিযানে এই গ্রুপের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই গ্রেফতার কিংবা মারা পড়েছে। তবে বর্তমানে ‘ডন ভাই’ নামে একটি গ্রুপ এখনও সক্রিয় রয়েছে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি আবু মোহাম্মদ আল বাঙালি নামে যে ব্যক্তির নানারকম কর্মকাণ্ডের তথ্য তারা পাচ্ছেন, সেই ব্যক্তি এই ‘ডন ভাই’ হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, গত প্রায় বছর খানেক ধরে এই গ্রুপটি নীরবে সদস্য ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করেছে। এখন তারা আবার চোরাগোপ্তা হামলা শুরু করেছে। হলি আর্টিজান হামলার আগেও জঙ্গি গ্রুপটি সারাদেশে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে আসছিল।

পুলিশ কেন টার্গেট?

প্রায় এক মাসের ব্যবধানে দুটি হামলার ঘটনাতেই দেখা গেছে জঙ্গি গোষ্ঠীরা টার্গেট করেছে পুলিশ সদস্যদের। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা দুনিয়াতেই জঙ্গিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টার্গেট করে আসছিল। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম কর্মকর্তারাও বলছেন, একের পর এক পুলিশি অভিযানে জঙ্গিদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কারণে তারা পুলিশের প্রতি বেশি বিক্ষুব্ধ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তারা পুলিশ সদস্যদের টার্গেট করছে। পুলিশ সদস্যদের জঙ্গিরা তাদের ভাষায় ‘তাগুত’বলে অভিহিত করে থাকে। এছাড়া পুলিশকে টার্গেট করতে পারলে তাদের প্রচার-প্রচারণাও বেশি হয় বলে মনে করে তারা।

জঙ্গিদের প্রোপাগান্ডা বিষয়ক বিভিন্ন প্রকাশনা ও তাদের নিজস্ব টেলিগ্রাম চ্যানেলে নজরদারি করে দেখা গেছে, জঙ্গিরা তাদের ভাষায় ‘তাগুত’হিসেবে পুলিশকে টার্গেট করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। মূলত তারা প্রতিশোধের অংশ হিসেবে পুলিশকে টার্গেট করছে। এছাড়া জনমনে ভয় ধরানো এবং শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেদের সুসংগঠিত করাও তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর