রাজধানীজুড়ে কিশোর গ্যাং এর তৎপরতা ও নেপথ্যে

রাজধানী জুড়ে বিগত কয়েক বছর ধরে চলছে কিশোর গ্যাং এর নানা অপকর্ম, চাঁদাবাজি, মারামারি, ধর্ষণসহ মাদকসেবন ও মাদক ব্যবসা। এদিকে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সাফল্য ও দায়িত্বশীলতা প্রশংসনীয় হলেও থেমে নেই কিশোর গ্যাং এর চলমান কুকীর্তি।। ঢাকা শহরের অলিগলি সবখানেই সক্রিয় হয়ে রয়েছে কিশোর গ্যাং।।

হাতে অস্ত্র, মুখে মাদক নিয়ে নানা ভঙ্গিমার ছবি আর এই ছবির ছড়াছড়ি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়।। নাম শ্রাবণ(১৮)। অস্ত্র ও মাদক নিয়ে নানা বিকৃত ভঙ্গিমায় ছবি ছড়িয়ে দেয়া তরুণ বয়সের কে এই শ্রাবণ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অস্ত্র হাতে ছবিগুলোর সূত্র ধরে গোয়েন্দা বাহিনী নিয়ে অনুসন্ধানে নামে র‌্যাব। এক পর্যায়ে পাওয়া গেল, শ্রাবণের সন্ধান। দুরন্ত তরুণ ছেলেটির পেছনে কয়েকদিন ছোটাছুটি করে অবশেষে গ্রেফতার করা হলো তাকে। তবে গ্রেফতারের পর বেরিয়ে এলো নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। এ যেন সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।

র‌্যাবের অনুসন্ধানে জানা গেল, শ্রাবণ নামের দৃশ্যমান দুরন্ত তরুণ মূলত নারী। ভয়ংকর অপরাধীদের একটি গ্যাংয়ের দুর্ধর্ষ তরুণী সদস্য তিনি। যে কয়জন বন্ধু মিলে এক সাথে থাকেন, তারা সবাই পুরুষ। তাদের মধ্যে গ্যাং লিডার ছাড়া আর কেউ জানে না যে শ্রাবণ একজন ভিন্ন লিঙ্গের মানুষ। একজন তরুণী। আর এই গ্যাংটি ছিনতাই, অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসাসহ নানা ধরণের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। শ্রাবণ হচ্ছে এই ভয়ংকর গ্যাংয়ের বিশেষ আকর্ষণ।

অপরদিকে রাজধানীর উত্তরার দক্ষিণখান এলাকা থেকে চাঞ্চল্যকর আদনান হত্যা মামলার সাথে জড়িত কিশোর গ্যাং ৯জন আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত ৩০জুন রবিবার রাত আনুমানিক ১২টার দিকে দক্ষিণখান থানাধীন পূর্ব ফায়দাবাদ জোড়া বিল্ডিং এর পেছনে সাইদ হাজির ভাড়া দেয়া রিক্সার গ্যারেজ থেকে কিশোর গ্যাংয়ের নয়জন সদস্যকে গ্রেফতার করে দক্ষিণখান থানার এসআই আসাদুজ্জামান আসাদ এর নেতৃত্বে একটি চৌকস টিম। গ্রেফতারের পর তাদের কাছে দেশিয় অস্ত্র দা ১টি, চাপাতি ৪টি, ছুরি ৪টি পাওয়া যায়।

ছবি: বার্তা বাজার।

উত্তরায় কিশোর গ্যাং অনেকটাই সক্রিয়। চুরি, ছিনতাই ও খুনসহ অনেক অপরাধের সাথে জড়িয়ে আছে এই কিশোর গ্যাং। পুলিশের কাছ থেকে জানা যায়- তারা উত্তরার আলোচিত আদনান হত্যা এবং দক্ষিণ খানের তানিয়া হত্যার মূল আসামী। খোঁজ নিয়ে দেখা যায় তাদের নামে উত্তরা ডিভিসনের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। মিজানুর রহমান মিজান ওরফে হাত কাঁটা মিজানের নেতৃত্বে মূলত এই কিশোর গ্যাংগুলো বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত থাকতো। তাদের নামে দক্ষিণখান থানায় মামলা নং-২, তাং-১/৭/১৯, ধারা-৩৯৯/৪০২ একটি মামলা রুজু হয়ে আসামিদ্বয়কে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান খুন হয়। ১০-১৫ জন তরুণ ধাওয়া করে আদনানকে ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। হাসপাতালে নেয়ার ঘণ্টা খানেকের মাথায় তার মৃত্যু হয়।

সেসময় র‍্যাব-১ এর একটি আভিযানিক দল উত্তরা সেক্টর-১৪, রোড নং-১৭ এলাকায় একটি অভিযান পরিচালনা করে উত্তরার চাঞ্চল্যকর আদনান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ৩ নং আসামি এবং ডিসকো বয়েস গ্যাং গ্রুপের দলনেতা শাহরিয়ার বিন সাত্তার সেতু ওরফে রায়হান আহম্মেদ সেতু ওরফে ডিসকো সেতু (২২), ধলিপাড়া, তুরাগ, ঢাকা মহানগর’কে গ্রেফতার করে। পরে তার দেয়া তথ্যমতে একই রাতে উত্তরা সেক্টর-১৪, রোড নং-৯ এলাকায় আরেকটি অভিযান পরিচালনা করে আদনান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি এবং বিগ বস্ গ্যাং গ্রুপের দলনেতা মোঃ আক্তারুজ্জামান ছোটন (১৯)।

ওই ঘটনার পর আদনানের বাবা মোঃ কবির হোসেন উত্তরা পশ্চিম থানায় ৯জনের নাম উল্লেখ করে আরো ১০-১২ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। আসামিদের সবার বয়স ১৬ থেকে ২২বছরের মধ্যে।

আবার রাজধানীর উত্তরখান এলাকায় সোহাগ হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। এ ঘটনায় গ্রেফতার করেছে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত দুই আসামি। এরা হলেন হলো-সাদ আল রাফী ও মোঃ নাজমুল হুদা ওরফে নাদিম। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের একটি টিম শনিবার বিকালে তাদের গ্রেফতার করে।

গোয়েন্দা উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার কায়সার রিজভী কোরায়েশী বলেন, গত ২৭ আগস্ট রাত ৮টায় উত্তরখান থানার খ্রিস্টান পাড়া ডাক্তার বাড়ি মোড় এলাকায় গ্রেফতারকৃতদের বন্ধু হৃদয়ের শরীরে রিকশার চাকা থেকে কাদা পানি ছিটে লাগলে রিকশা চালককে হৃদয় মারধর করে। এ সময় ভিকটিম সোহাগ হৃদয়ের কাছে রিকশাচালকের মারধরের কারণ জানতে চায়। বাদানুবাদের এক পর্যায়ে সোহাগ হৃদয়কে থাপ্পড় মারে। এই ঘটনায় হৃদয় তার বন্ধুদের কাছে বিষয়টি জানিয়ে ঘটনাস্থলে আসতে বলে।

বন্ধুরা ঘটনাস্থলে এসে সোহাগের কাছে হৃদয়কে মারার কারণ জানতে চেয়ে তর্কাতর্কি করে। এরই এক পর্যায়ে হৃদয়ের বন্ধু মাহবুবুল ইসলাম ওরফে রাসেল ওরফে কাটার সোহাগের পেটে ছুরিকাঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় ভিকটিম সোহাগকে উত্তরার নসট্রাম হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার নেয়া হলে হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় ভিকটিমের ভাই উত্তরখান থানায় অভিযোগ দায়ের করলে হত্যা মামলা রুজু হয়। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় অভিযুক্তদের অবস্থান শনাক্ত করে খিলগাঁও গোড়ান এলাকা হতে সাদ আল রাফীকে ও গাজীপুর মহানগর পুলিশের গাছা থানা এলাকা থেকে নাজমুল হুদা ওরফে নাদিমকে গ্রেফতার করা হয়।

গত ১৬ সেপ্টেম্বর বুধবার গভীর রাতে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কেওঢালা এলাকা থেকে শ্রাবণসহ এই গ্যাংয়ের পাঁচজনকে আটক করেছে র‌্যাব-১১ ব্যাটালিয়নের একটি দল।

তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে দুইটি চাইনিজ কুড়াল, ২টি স্টিলের চাকু, স্টিলের তৈরি ২টি ছুরি, ১টি রামদা, ১টি তরবারি, ১টি পিস্তলের কভার, ১টি হাসুয়া এবং ৩০০ পিস ইয়াবা।

আটককৃত অপর চারজন হলেন, গ্যাং লিডার আমিনুল ইসলাম ওরফে শাহিন (৩৭), সাদেক হোসেন (৩০), ইয়াছিন আহম্মেদ ওরফে জুনায়েদ (২২) ও আশিকুর রহমান শিকদার ওরফে শাকিব (২২)।

বৃহস্পতিবার রাতে র‌্যাব-১১ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

র‌্যাব আরও জানায়, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, সন্ত্রাসী আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি কিশোর গ্যাংচক্র মদনপুর এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসাসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজ করে আসছিল এবং তার বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।

র‌্যাব-১১ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী জানান, আটককৃতরা দুর্ধর্ষ পেশাদার সন্ত্রাসী, অপহরণকারী ও চাঁদাবাজ চক্রের সক্রিয় সদস্য। তারা দীর্ঘদিন ধরে দেশীয় ধারালো অস্ত্র প্রদর্শন করে সংঘবদ্ধভাবে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, মাদক ব্যবসাসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন। তাদের এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ বেশ কিছু ছবি পাওয়ার পর দীর্ঘদিন যাবৎ গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে এই সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী চক্রকে শনাক্ত করে র‌্যাব। এর পরেই অভিযানে নেমে পাঁচজনকে অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেফতার করা হয়।

কিশোর গ্যাং সমগ্র ঢাকা জুড়ে রয়েছে। মূলত এদের সক্রিয় হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। পরিবারিক, খারাপ বন্ধুবান্ধব, প্রেম ভালবাসা কিংবা মাদক থেকেই শুরু হয় তাদের অপকর্ম। এ বিষয়ে নিজ পরিবার ও প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত বলে মনে করেন সচেতন মহল।

বার্তা বাজার / ডি.এস

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর