শিক্ষকতায় ত্রিশ পেরিয়ে একত্রিশে অধ্যাপক জাকারিয়া রহমান

আমাদের আশেপাশে এমন কিছু মানুষ রয়েছেন যারা আত্ন-প্রচারণায় বিশ্বাস করেন না। তারা আপন মনে নিজের মতো কাজ করে যাওয়াতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। তারা পর্দার পেছনের কারিগর হয়েই বেশী আনন্দ পান। বস্তুত এভাবেই তারা নিরবে নিভৃতে কাজ করে দেশ ও জাতিকে ঋণী করছেন প্রতিনিয়ত। তাদের নিয়ে সমাজে তেমন মাতামাতি হয় না। এতে অবশ্য তাদের থোড়াই কেয়ার। কাজ প্রিয় এসকল মানুষের একটাই আনন্দ তারা নিজেদের ভালো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত রেখেছেন। সমাজের গতিপথ পরিবর্তনে কিছু করতে পারছেন। প্রকৃত অর্থে স্বীয় কর্মের মাধ্যমে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানোই তাদের মূল উদ্দেশ্য।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোঃ জাকারিয়া রহমান তাদেরই একজন। সম্প্রতি যিনি শিক্ষকতায় ত্রিশ বছর পূর্ণ করে একত্রিশ এ পদার্পণ করেছেন। ৩০ বছরের এ পথ চলা ছিল মিশ্র অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। তবে দৃঢ় সংকল্প আর প্রবল আত্মবিশ্বাস তার চলার পথের পাথেয় হয়ে সামনে এগিয়ে চলায় মূখ্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।

অধ্যাপক ড. জাকারিয়া রহমান জন্মে ছিলেন পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলার রসেয়া গ্রামের সম্ভান্ত্র এক মুসলিম পরিবারে। বাবা-মায়ের ৬ সন্তানের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। তার বাবা মোঃ আব্দুল জলিল। মা আরেফা খাতুন।

নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহনের মধ্য দিয়ে ড. জাকারিয়া রহমান তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এরপর ১৯৭৫ ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি তার মাধ্যমিকের পাঠ শুরু করেন। পরবর্তীতে দিনাজপুর সরকারি কলেজে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ১৯৮২ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হন। কৃতিত্বের সাথে স্নাতক শেষে সেখানেই তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। ২০০২ সালে তিনি ভারতের পুণা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

কিশোর বয়স থেকেই সাংস্কৃতি চর্চায় ঝোক ছিল। প্রবল আগ্রহ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুশীলন নাট্য দলের সাথে যুক্ত হন। সেখান থেকেই পথ নাটক, মঞ্চ নাটক সহ রাবির সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নানা আয়োজনে তার ছিল অবাধ বিচরণ। মূলত এখান থেকেই তার প্রগতিশীলতা চর্চার হাতেখড়ি।

ড. জাকারিয়া রহমান ১৯৯০ সালে মার্কেট রিসার্চ কনসালট্যান্ট বাংলাদেশে তার কর্মজীবন শুরু করেন। সল্প সময়ের জন্য সেখানে খণ্ডকালীন চাকরি করেন তিনি। এরপর ১৯৯০ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করার দুই মাসের মাথায় সে বছর ৩০ শে আগষ্ট ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ২০০৭ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ২০১০ সালে তিনি ব্যবসা প্রশাসন অনুষদের ডিন হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১১ সালে তিনি ব্যবস্থাপনা বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ইবির মার্কেটিং বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টানা ২ বার তিনি মার্কেটিং বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

অধ্যাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সহায়ক কাজের পাশাপাশি তিনি দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিভিন্ন জার্নাল এবং আন্তর্জাতিক সেমিনার, সম্মেলন ও ওয়েবিনার এ অংশ গ্রহণ করেছেন। এর বাইরে তিনি ব্যবস্থাপনা ও বিপণন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গবেষণা মূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও তিনি ২ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও অতিথি শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপনা করেছেন। তার এ পর্যন্ত ২০ টির অধিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে ২ টি সেমিনার পেপার। এছাড়া ইউজিসির অর্থায়নে একটি গবেষণা প্রবন্ধ সম্পন্ন করেছেন। অপর একটি চলমান রয়েছে।

বর্তমানে তিনি ইবির ব্যবস্থাপনা বিভাগের অন্যতম জেষ্ঠ অধ্যাপক। পাশাপাশি তিনি ২ বারের সিন্ডিকেট সদস্য এবং একাডেমিক কাউন্সিল এর মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

চাকরি জীবনের শুরু থেকেই অধ্যাপক জাকারিয়া রহমান প্রগতিশীল শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। সর্বশেষ ২০১৮ সালসহ বেশ কয়েকবার তিনি এর কার্যনির্বাহী সদস্য ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীলতায় বিশ্বাসী শিক্ষক সংগঠন শাপলা ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ১৯৯১-২০২০ পর্যন্ত অধিকাংশ সময় এর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। তিনি ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু পরিষদ ইবি শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৬-০৮ সাথে তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এর বাইরে তিনি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী, অরাজনৈতিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে বহুবছর ধরে যুক্ত রয়েছেন।

তিনি শিক্ষার্থীদের পাঠদানের পাশাপাশি খেলাধুলা, নাটক, অভিনয়, নৃত্য সহ প্রগতিশীলতা ও সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য বরাবরই অনুপ্রাণিত করেছেন। এসবের অপরিহার্যতার কথা তুলে ধরেছেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর দিকে (কুষ্টিয়ায়) যে ক’জন শিক্ষকের হাত ধরে প্রগতিশীল ধারার সংস্কৃতি চর্চা শুরু হয় অধ্যাপক জাকারিয়া রহমান তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। ১৯৯১ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী তার তত্ত্বাবধানেই ইবি (কুষ্টিয়া শহরে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে) শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রথম কোনো নাটক মঞ্চস্থ হয়। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে তিনি তৎকালীন সময়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের রোষানলে পড়েছিলেন বলে জানা যায়। ভাগ্যগুণে সে যাত্রায় অল্পের জন্যে রেহাই পান। তবুও তিনি কখনো অপশক্তির কাছে মাথা নত করেননি। তার হাত ধরেই ইবিতে প্রথম কোনো নৃত্য বিষয়ক সংগঠন নৃত্যঙ্গন এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। বর্তমানে তিনি সংগঠনটির প্রধান উপদেষ্টা।

অধ্যাপক জাকারিয়া রহমানের কর্মে তার প্রাঞ্জলতা ফুটে ওঠে। বিচিত্র বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ও কর্ম দক্ষতার মধ্য দিয়ে তা প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন সময়ে এর মাধ্যমে তিনি বিদগ্ধ জনের দৃষ্টি কাড়তেও সক্ষম হয়েছেন। তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান ফটক সংলগ্ন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টিনন্দন মূর‍্যাল মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ৪র্থ সমাবর্তন আয়োজন স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং মঞ্চ সজ্জা কমিটির আহ্বায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৭ সাল থেকে তিনি ইবি সৌন্দর্য বর্ধন কমিটির আহ্বায়ক। এর মাধ্যমে তিনি ইবি লেকসহ বিভিন্ন স্থাপনার সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করে চলেছেন। ২০২০ এ বোটানিক্যাল গার্ডেন সহ ক্যাম্পাসের উন্মুক্ত জায়গায় তিনি এ পর্যন্ত ফলজ, বনজ ঔষধীসহ প্রায় ২০ হাজার বৃক্ষ রোপণ করেছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে খেলাধুলাসহ সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।

৩০ বছরের বেশি সময় নিরলসভাবে শিক্ষকতা করছেন অধ্যাপক ড. জাকারিয়া রহমান। ব্যাক্তি জীবনে তিনি ২ সন্তানের জনক। তার সহধর্মিণী মমতাজ পারভিন সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

দীর্ঘ এ কর্মযজ্ঞ জুড়ে শিক্ষক হিসেবে তার উপর আবর্তিত দায়িত্ব ও এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস সহ নানা মাত্রিক কল্যাণমুখী কাজের সঙ্গে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করে অর্থবহ করে তুলেছেন। সাদামাটা জীবন যাপনে আগ্রহী এ মানুষটি কারো তোষামোদ না করে সবসময় আপন খেয়ালে নিজের মতো কাজ করে গেছেন। তার মতে, তিনি চেষ্টা করেছেন কর্মের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে। কোন পুরস্কারের মোহ বা অনুরাগ-বিরাগ কোনো সময় তাকে আকর্ষণ করেনি। তার শুভাকাঙ্ক্ষী, শুভানুধ্যায়ী আর শিক্ষার্থীদের ভালবাসাই তার সাফল্য। এটাই তার প্রাপ্তি। এটাই তার মূল চালিকাশক্তি।

লেখক: মোস্তাফিজুর রহমান রাকিব
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

বার্তাবাজার/অমি

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর